বেড়াজাল পেড়িয়ে -মৌমিতা ব্যানার্জী
বৃষ্টি পড়ছে ঝম্ ঝম্ করে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তৃধা। বৃষ্টি তার বড়ই পছন্দের ছিল কোনো এক সময়ে, কিছু বছর আগেও সে কাগজের নৌকা তৈরি করে জলে ভাসিয়েছে আর হারিয়ে গেছে কল্পনার জগতে। কিন্তু আজ সবই অতীত,,,,,,,,,সবকিছুই আজ ইতিহাস মনে হয়। না সে এখন আর বেরোয় না ঘর থেকে, শুধুই কি সমাজের জন্য??? না সে নিজেও ঘৃণা করে নিজেকে আর তার মুখকে। তাই সে আজ লোকচক্ষুর অন্তরালে। কিন্তু তার দোষটা কী ছিল? সত্যিই কী কোনো দোষ ছিল তৃধার ?? আচ্ছা প্রতিবাদ করা কী সত্যিই অপরাধের ? এইসব ভাবতে ভাবতেই তৃধা ডুব দিল এক বছর আগে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর অতীতে…………..
তখন তৃধার বি.এ ফাইনাল ইয়ার পড়াশুনার খুব চাপ ছিলো। কিন্তু তৃধা বরাবরই খুব সাহসী আর প্রতিবাদী মেয়ে, অন্যায় দেখলে কিছুতেই চুপ থাকতে পারে না। একদিন টিউশন পড়ে ফেরার পথে বাঁধল বিপত্তি। পাড়ারই এক বৃদ্ধা মহিলা সম্বল বলতে ছোট একটি বাড়ি। তিনকূলে কেউ নেই বৃদ্ধার, আর এই বাড়ির দিকেই নজর পড়েছে পাড়ার প্রমোটারের। সেই দিন তৃধা টিউশন ফেরার পথে দেখলো বৃদ্ধাকে তাঁর বাড়ি ছাড়ার জন্য রীতিমতো হুমকি দিচ্ছে সেই প্রমোটার। প্রতিবাদী তৃধা আর সহ্য করতে না পেরে তখনই ভিডিও করে পুলিশের কাছে কমপ্লেন করে, পুলিশ দায়সাড়া কমপ্লেন নিলো, অ্যারেস্ট করলো ওই প্রমোটারকে কিন্তু সবই লোক দেখানো কিছু দিন পরই প্রোমোটার ছাড়া পেলো।
সেদিন টিউশন শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল তারপর আবার তৃধার বান্ধবী শ্ৰীতমাও আসেনি, তৃধাকে একাই ফিরতে হবে, সে একাই বেড়িয়ে পড়ল,,হটাৎ তার রাস্তা আটকিয়ে দাড়ালো সেই প্রমোটার আর তার পোষা গুন্ডারা ৷ তৃধা ওদের দেখে চলে যেতেই প্রোমোটার তৃধার মুখে ছুড়ে মারল অ্যাসিড ৷ চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তৃধা,পাড়ার অনেকেই দেখেছিল সেই দৃশ্য কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতে আসেনি সেই দিন এমনকি কেউ তাকে হসপিটালে অবধি নিয়ে যায়নি, এক কঠিন বাস্তব সত্যের সম্মুখীন হয় সেদিন তৃধা। সেদিন তার বান্ধবী শ্রীতমাই তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়,রাস্তায় তৃধাকে পড়ে থাকতে দেখে শ্রীতমা ও তার পরিবার তাকে হসপিটালে নিয়ে যায়। একমাসের কঠিন লড়াইয়ের পড় তৃধা যখন তার বাবা মায়ের সাথে বাড়ি ফিরলো দেখলো তার মুখের একপাশ সম্পূর্ন পোড়া, এইদৃশ্য তৃধার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। না সেদিন কিন্তু কেউ তার পাশে এসে দাড়ায়নি, শুধু শ্রীতমার পরিবার ছাড়া। আর রইলো বাকী দোষীদের কথা? না তারাও কোনো শাস্তি পায় নি। কোর্টে শুধু ডেট এর পর ডেট আর শেষে বিচার হলো উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে দোষীরা বেকসুর খালাস পেলো। সমাজের নির্মম দিকটা সেদিন মর্মে মর্মে অনুভব করেছিল তৃধা, তাই সে এই কয় মাসে নিজেকে সম্পূর্নভাবে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে।।
এতক্ষণ এক বছর আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভাবতে ভাবতে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল তৃধার চোখ,,,,, ক্ৰীং ক্রীং ক্রীং ,হঠাৎই ফোনের আলো জ্বলে উঠল, ডিসপ্লেতে ভেসে ওঠল শ্রীতমার নম্বর, ফোন ধরাতেই শ্রীতমা এক নিঃশ্বাসে কিছু কথা বলল শেষে বলল -‘ দরজা খোল আমি আসছি তোদের বাড়িতে ৷ ‘ শ্রীতমা এলো তৃধার বাড়িতে সঙ্গে দুটো কাগজের নৌকা ৷ তৃধাকে একপ্রকার ঘর থেকে টেনে বার করলো শ্রীতমা, আর হাতে তুলে দিলো কাগজের নৌকা। অনেক দিন পর পুরানো স্মৃতিচিহ্ন দেখে আনন্দে আত্মহারা হলো তৃধা। মনের সুখে নৌকা ভাসালো জলে আর তার সাথে ভাসিয়ে দিলো সব দুঃখ-আপমান-যন্ত্রনা৷ তৃধা বুঝল সে সমাজ তাকে সাহায্য করে নি, তার দুঃখে দুঃখী হয়নি,সেই সমাজ তার মুখ নিয়ে কী ভাবল বা কী বলল সেটা সে ভাববে কেন? সে আর ঘরে বসে থাকবে না, সে তার নিজের ইচ্ছায় চলবে,আর বাঁচবে তার বাড়ির জন্য আর তার বান্ধবী শ্রীতমার জন্য। সমাজকে কাঁচকলা দেখিয়ে সমাজের বেড়াজাল পেড়িয়ে সেও বাঁচবে তার মতো। নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো মেলে ধরবে খোলা আকাশে,,,আর তার সাক্ষী হবে গোটা সমাজ ও সমাজের ভালো মুখোশ পড়া মানুষগুলো ৷