
মা- দিলীপ কুমার ঘোষ
এটা এখন ওপেন সিক্রেট। সকলেই জেনে গেছে আমি ছেলে পছন্দ করি। কারও সন্তান হয়েছে শুনলেই প্রথমে আমার মনে হয় পুত্রসন্তানের কথা। এটা আমার অবচেতনে এমন ঢুকে গেছে যে, কারও মেয়ে হয়েছে শুনলে প্রাথমিক একটা ধাক্কা লাগে।
ঈশ্বরের অসীম করুণাই বলতে হবে আমার দু’টিই ছেলে। বিয়ের বছর না-ঘুরতেই পুত্রের জনক হয়ে আমি খুব পরিতৃপ্ত হয়েছিলাম। আমার নিজেকে সার্থক মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল আমার বিয়েও সার্থক। ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’র আলোকে স্ত্রী হিসাবে নবনীতাকেও সার্থক মনে হয়েছিল।
বছর পাঁচেক পর আমাদের দ্বিতীয় সন্তান আসার ব্যাপারটা আমি অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম। তার জন্য অবশ্য নবনীতাকে দোষারোপ করা যায় না। ও নিজেও প্রথমে বুঝতে পারেনি। সন্দেহ হওয়ার সাথেসাথেই আমাকে জানিয়েছিল। কিন্তু ইট’স টু লেট! পরিবারের সকলে, বিশেষ করে মা এই দ্বিতীয় সন্তান আগমনের সংবাদে খুব খুশি হল। মাকে দেখে মনে হল একটা বোঝা যেন মায়ের কাঁধ থেকে নেমে গেল।
নবনীতার কাছ থেকে মা মাঝেমধ্যেই সন্তানাদি নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত জানতে চাইত। মা ঘনঘন জানতে চাইলে নবনীতা আমাকে বিরক্ত করত, “মাকে কী বলি বলো তো? তুমি তো কিছুতেই রাজি হচ্ছ না। কিন্তু কেন আর সেকেন্ড ইস্যু চাইছ না, সেটাও পরিষ্কার করে বলছ না!… আমার হয়েছে যত জ্বালা! এরপর মা কিছু জানতে চাইলে আমি মাকে বলব, ‘আপনি সরাসরি আপনার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করুন।'”
আমি মায়ের একমাত্র সন্তান। অনেক চেষ্টা- চরিত্তের পরেও মা আর দ্বিতীয় সন্তানের জননী হতে পারেনি। এটা ছিল মায়ের জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ। তা-ই মা সবসময় আমাদের কাছে তারএকাধিক নাতি-নাতনির ইচ্ছার কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রকাশ করত।
হয়তো একমাত্র সন্তান বলেই মা সবসময় আমাকে নিয়ে ভীষণ টেনশন করত। খালি বলত, “সাত রাজার ধন এক মাণিক সামলানো বড় চাপের
রে! যাকে সামলাতে হয়, সে-ই বোঝে!” প্রায় সকলেই আমাদের দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে হোক চাইলেও আমি প্রাণপণে পুত্রসন্তানই চেয়েছিলাম। আমি একটা কথা কাউকে, এমনকি
নবনীতাকে পর্যন্ত জানতে দিইনি। পৃথিবীতে আমার দ্বিতীয় সন্তান না-আনতে চাওয়ার কারণ ছিল মেয়ে হওয়ার এই পঞ্চাশ শতাংশ সম্ভাবনা! আমাদের প্রথম সন্তান মেয়ে হলে আমি অবশ্য চাইতাম যত দ্রুত সম্ভব আমাদের দ্বিতীয় সন্তান পৃথিবীতে আসুক। তবে সেই দ্বিতীয় সন্তানকে অবশ্যম্ভাবীভাবে ছেলে হতে হত! দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে হতেই পারে ভেবে আমার রিপুর তাড়নাকে পর্যন্ত আমি মনে মনে কার্যত ধিক্কার জানাতাম। নবনীতার মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে ওকে নিয়ে টার্মিনেশনের জন্য আমি ডাক্তারের কাছে পর্যন্ত দৌড়েছিলাম। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে বলে ডাক্তার কিছুতেই সম্মত হননি।
সেই সময় উদ্ভ্রান্ত আমাকে দেখে মনে হয় মা কিছু সন্দেহ করেছিল। নাহলে নবনীতা যেমন ধাতের মেয়ে মাকে কিছু জানাবে বলে মনে হয় না। মা আমাকে একদিন তার ঘরে ডেকে পাঠিয়ে পাশে বসে বলল, “খোকা, তোর কী হয়েছে বল তো? তোকে কয়েকদিন ধরে দেখে মনে হচ্ছে কোনও বিষয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছিস!” আমি আর নিজেকে সামলাতে না-পেরে দুম করে বেশ ক্ষোভের সাথে বলে উঠলাম, “আমাদের দ্বিতীয় সন্তান যদি মেয়ে হয়?” মা সেদিন আমার আচরণে যারপরনাই অবাক হয়ে বলেছিল, “সে কী রে খোকা, এটা আবার কোনও চিন্তার বিষয় হল! সন্তান সন্তান, তার আবার ছেলে-মেয়ে কী! ভেবে দেখ, আমি তো মেয়ে! তার জন্য তুই কি আমাকে কম ভালবাসিস? যে তুই আমাকে এত ভালবাসিস, সেই তোর কিনা এত মেয়ে অপছন্দ!”
মা’র পারলৌকিক ক্রিয়া-কর্মের পর রাতে অনিদ্রায় ছটফট করতে করতে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। যত শীঘ্র সম্ভব একটি কন্যা দত্তক নেওয়ার জন্য যথাস্থানে আবেদন করব।
দিলীপ কুমার ঘোষ:
পেশায় শিক্ষক দিলীপ কুমার ঘোষের জন্ম হাওড়া জেলায় ডোমজুড় ব্লকের দফরপুর গ্রামে। নরসিংহ দত্ত কলেজে পাঠ শেষ করে রবীন্দ্রভারতী থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর। নেশা ক্রিকেট, সিনেমা, ক্যুইজ, রাজনীতি। নিমগ্ন পাঠক, সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত সৈনিক। কয়েকটি ছোটবড় পত্রিকা এবং ওয়েবজিনে অণুগল্প, ছোটগল্প এবং রম্যরচনা প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘সুখপাঠ’ এবং ‘উদ্ভাস’ পত্রিকায় রম্যরচনা এবং দ্বিভাষীয় আন্তর্জালিক ‘থার্ড লেন’-এ ছোটগল্প প্রকাশ পেয়েছে। একটি প্রকাশিতব্য হাস্যরসাত্মক গল্পগ্রন্থের অন্যতম গল্পকার।