বাঁদরামি - অমিত সিংহ।
রোজ রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ছাদে পায়চারি করা আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। তাই আজকেও অফিস থেকে ফিরে এসে রাতের আহার সুসম্পন্ন করে ছাদে উঠে পাইচারি করছি আর নৈশ্যকালীন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি। রাত এগারোটা বেজে গেছে। চারদিকটা বেশ নিস্তব্ধ। নির্মল শান্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেশ ভালো লাগে আমার তবে তা আজ আর হল না। ছাদে পায়চারি করতে করতে চোখটা উওর দিকে ছোট ডোবার পাশে পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়িটার পাশে নারকেল গাছটায় গিয়ে স্থির হল। চোখ দুটো সাথে সাথে বিস্ফারিত হয়ে গেল আমার। গাছে ওইটা কি?
অন্ধকারে পরিস্কার কিছু বোঝা না গেলেও এইটা পরিস্কার যে গাছে কিছু একটা আছে। চোখ দু’টো রগড়ে নিলাম। আবার গাছটার দিকে তাকালাম। ওই তো এখনো আছে। পা দুটো কেঁপে উঠল। চোখ দুটো ঝাপ্সা হয়ে গেল। আমি মনে হয় এবার অজ্ঞান হয়ে ছাদেই পরে যাব । তাও শরীরে সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে কোনরকমে নীচে নামছিলাম। আমার গিন্নি তখন ছাদের দিকেই যাচ্ছিল আমাকে ঘুমাতে যেতে বলার জন্য। আমার বিস্ফারিত দু’টো লাল চোখ , ফ্যাকাশে আতঙ্কিত মুখমন্ডল দেখে গিন্নি কিছুটা চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল
‘ ওগো! কি হয়েছে তোমার। শরীর খারাপ করছে নাকি।’
আমার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে গেল ‘ভূত !’। এবার দেখলাম গিন্নির ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হল তারপর গলার স্বর কঠিন করে বলে উঠল ‘কি যা তা বলছ ’। ইতিমধ্যে গিন্নির চিৎকার শুনে আমার ছেলে রনিন উপস্থিত হয়েছে। সব ঘটনা তার মায়ের মুখে শোনার পর তার কি হাসি। অবশ্য হাসবে নাই বা কেন আমি তাকে কত গর্ব করে বলেছি ছোটবেলায় নাকি আমি ভূত দেখার জন্য রাতে বের হতাম , আর আজ কিনা ভূত দেখে আমার এই অবস্থা। সত্যি কথা বলতে ছেলে আর গিন্নিকে দেওয়া সমস্ত ঢপ আজ মিথ্যা প্রমাণিত হল। গিন্নি রেগে গিয়ে বকবক করেই চলেছে দেখে রনিন আমার দিকে তাকিয়ে উপহাসের হাসি হেসে তার মা কে বলল ‘ চল মা। বাবা যখন ভূতের ভয় পেয়েছে তখন নিশ্চয়ই ভূত আছে ছাদে। চল একবার দেখেই আসি কোথায় ভূত।’ ছেলের উপহাস আর গিন্নির বকবকানি সহ্য হল না। সমস্ত ভয় বিসর্জন দিয়ে বিজয়ী সেনার মতো ছাদে উঠলাম। ছাদে উঠে চোখ বন্ধ করেই তর্জনী তুলে গাছের দিকে দেখলাম। আমি যেমন গাছের উপর বসে কাউকে পা দোলাতে দেখেছি গিন্নি হয়তো সেই দৃশ্যই দেখে ‘ও বাবা গো মা গো!’ চিৎকার করতে করতে ছাদ থেকে নীচে নেমে গেল। রনিন পকেট থেকে স্মার্ট ফোনটা বার করে সেই জিনিসটার কয়েকটা ফটো তুলে নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ছাদ থেকে নীচে নামতে থাকলো। পিছন পিছন আমিও। আতঙ্কে সারারাত জেগেই কাটালাম। মনে মনে স্থির করলাম সকাল হলেই কমিটিতে গিয়ে ব্যাপারটা জানাতে হবে।
এই পাড়ার সমস্ত লোকেরা মিলে একটা কমিটি গড়ে তুলেছে। কেউ কোন সমস্যায় পড়লে সবাই মিলে তার সমাধান করে। কমিটির সভাপতি দিনেশ মুখার্জি খুব কড়া ধাঁচের লোক। তাকে এই এলাকায় সবাই খুব সম্মান করেন। একজন রিটায়ার্ড ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসার ছিলেন। এলাকায় এমন কোন লোক নেই যে কেউ তার দৈহিক গঠন আর মেজাজে ভয় করে না। এছাড়াও কমিটিতে বৈজ্ঞানিক, সাংবাদিক, পুলিশ, উকিল, ডাক্তার থেকে শুরু করে সর্বত্র পেশার মানুষ বর্তমান। তারা তাদের নিজ নিজ ব্যাখ্যা নিজ নিজ পেশার ভিত্তিতে সমাধান করে থাকেন। আজ পর্যন্ত কমিটি কোন ভুল সিদ্ধান্ত বা ভুল বিচার করেছে তা শোনা যায় না। তা ভাবলাম আমার ব্যাপরটাও হয়তো সঠিকভাবেই সমাধান করবে কমিটি। কিন্তু চিন্তা একটাই কেউ যদি ভাবে আমাদের পরিবারের সবার বোধ শক্তি লোপ পেয়েছে। সত্যি কথা বলতে বিজ্ঞানের যুগে দাঁড়িয়ে এইসব কথা বলা সত্যিই হাস্যকর। কিন্তু স্মরণে এল রনিনের স্মার্টফোনের মধ্যে তো প্রমাণস্বরূপ ছবি রয়েছে। তাহলে আর কিসের ভয়। এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।
ঘুম ভাঙ্গলো নীচে রাস্তা থেকে আসা এলাকাবাসীর হৈচৈ শব্দে। সকালের আলো ফুটেছে তখন। কারোর কোন বিপদ হল নাকি। এই এলাকায় বিপদে সবাই সবার পাশে দাঁড়ায়। চোখে মুখে জল দিয়ে বাইরে বের হলাম। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম পাড়ার প্রায় সকলেই উপস্থিত। দীনেশ মুখার্জি সকলকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। আমি এইসব দৃশ্য দেখে কৌতূহলবশত দিনেশ মুখার্জির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘ দিনেশবাবু কি হয়েছে। এত ভিড় কিসের? ’ । দীনেশবাবু তার পুরু গোঁফটায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন ‘ কি হয়েছে সেটা ঠিক ঠাক আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। আর আপনাকে কি করে বোঝাব।’ দীনেশবাবুর এই কথা শুনে তাকে আর বেশি ঘাটলাম না। রতনবাবু ইতিমধ্যে তার ফোকলা দাঁত বার করে উপস্থিত হয়েছে। তবে আজ তাঁর ফোকলা দাঁত বার করে হাসিটা কোথায় যেন আড়াল হয়ে গেছে। আজ তাঁর মুখটা কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। রতনবাবু বেদনাময় কন্ঠে বলে উঠল ‘ সুবোধবাবু আমাদের পাড়ায় কি হচ্ছে এইসব? ’ ইতিমধ্যে আমি রাতে ভূত দেখার গল্পটা বেমালুম ভুলে গেছি।
‘কেন কি হয়েছে ?’ জিজ্ঞেস করায় রতনবাবুর চোখ দুটো জলে ভরে গেল তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল ‘ চুরি হয়েছে চুরি ’। রতনবাবুর এই কথাটা শোনার পর আমি রীতিমত আঁতকে উঠলাম। রতনবাবুর বাড়িতে চুরি! বেচারা আজ বাঁচবে তো! রতন বাবুর মতো মহা কৃপণ এই পাড়ায় আর কেউ নেই। আর আজ সেই মহা কৃপণের বাড়ি চুরি। রতনবাবুর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলাম ‘ কি চুরি হয়েছে?’ রতনবাবু তার ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগিয়ে মৃদু স্বরে বলল ‘ দু’দিন ধরে আমার বাগানের কলা কে যেন দুপুরবেলা আর রাতের বেলা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। আর পেয়ারা অর্ধেকটা খেয়ে বাগানে ছড়িয়ে যাচ্ছে।’ কথাটা শোনার পর বেশ হাসি পেল । সামান্য ফল চুরিতেই এই অবস্থা। এইটা হয়তো পাড়ার ছেলে ছোকরাদের বদমাইশি। তবে বাকিদের সমস্যা কি সেটা জানতে হবে।
ইতিমধ্যে দীনেশ মুখার্জি কমিটির ঘর খুলে দিয়েছে। গরু যেমন করে গোয়াল ঘরে প্রবেশ করে তেমনি আমরাও হুড়মুড়িয়ে ঢুকলাম। দীনেশ মুখার্জি তার আসনে বসে বলে উঠলেন ‘ একজন একজন করে সবাই বলুন।’ বিকাশবাবু বললেন, তার ছাদে কেউ যেন দুপুরবেলা আর রাতের বেলা নাচানাচি করে। প্রচন্ড আওয়াজ হয়। তিনি ঘুমাতে পারেন না। পুলিশ অফিসার শ্যামাকান্ত জানালেন, কিছুদিন আগে তিনি থানা থেকে নাইট ডিউটি করে ফিরছেন হঠাৎ দেখলেন কি যেন তার গাড়িটার সামনে থেকে লাফ দিয়ে পরিত্যক্ত বাড়িটার দিকে চলে গেল। অন্ধকার থাকায় জিনিসটা কি সেটা ঠিক বুঝতে পারেন নি। দত্ত গিন্নি রেগে জানাল ছাদে শুকোতে দেওয়া বড়ি কে ঘেঁটে দিয়েছে , তারপর আরেকদিন আচারের শিশি ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। সব এতক্ষণ মন দিয়ে শোনার পর রনিন তার স্মার্টফোনটা বার করে কাল রাতে তোলা ভূতের ছবি দেখাতে লাগল সবাইকে । তাই দেখে গোবিন্দ চন্দ্র হাইস্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক হরিপদ প্রামাণিক দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল ‘ রনিন তুমি নাকি সায়েন্সের ছাএ। তুমি এই সব ভূত প্রেত বিশ্বাস করছ। এইটা দেখে আমার সত্যি খুব দুঃখ হচ্ছে।’ রনিন কাচুমাচু মুখে পকেটে তাঁর স্মার্ট ফোনটা ঢুকিয়ে নিল। সবাই যখন ভেবেই নিয়েছিল এই সমস্ত ঘটনা ভূতের কাজ বা ছিঁচকে চোরের বা দুষ্টু ছেলেদের বাঁদরামি তখন সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল যখন হরিপদবাবু বললেন ‘ ছবিগুলো দেখে ভিনগ্ৰহের প্রাণী বা এলিয়েন মনে হচ্ছে। এই জগতে ভূত প্রেত দেবতা বলে কিছু নেই। সব অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার।‘ এই কথাটা শোনার পর ধার্মীক কালিপদ ব্যানার্জি হৈহৈ করে উঠল। তারপর হরিপদ প্রামাণিক আর কালিপদ ব্যানার্জির মধ্যে বেঁধে গেল তুমূল ঝগড়া। আমরা সকলেই নীরব শ্রোতা হয়ে উপভোগ করতে থাকলাম সেই দৃশ্য। দু’জনেই দু’জনের যুক্তির প্রমাণ দিচ্ছেন। কিন্তু একটা সময় এই ঝগড়া হাতাহাতিতে পৌঁছাছে দেখে দীনেশ বাবু সিংহের মতো গর্জন করে ধমক দিলেন। সবাই চুপ। তবে এখন কি করা যাবে সেই অন্তহীন ভাবনায় সবাই ডুব দিয়েছে। হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে আমি বলে উঠলাম ‘ আজ্ঞে যদি একবার সবাই মিলে আজ রাতটা জেগে পরিত্যক্ত বাড়িটার সামনে গিয়ে দেখা যায় যদি জিনিসটা কি তাহলে কেমন হয়? ’ দীনেশবাবুর কানে এই কথাটা যেতেই চকচক করে উঠলো তার চোখ তারপর বললেন ‘ সাব্বাস, মিস্টার বোস আপনার কোন তুলনা হয় না। সবাই মিলে একত্রিত হয়ে জিনিসটা কি সেটা দেখলেই তো কৌতূহল মিটে যায়। বাহ্ আপনি এক সহজ সরল সমাধান দিলেন বটে ।’ সবাই হাততালি দিয়ে আমার কথাটা স্বাগত জানাল। এতদিন চাকরি করে প্রমোশন না পাওয়া আমার মনে হল আজকেই প্রমোশন পেয়ে গেছি।
ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। জানলা দিয়ে দেখলাম সকলে উপস্থিত হচ্ছে পরিত্যাক্ত বাড়িটার দিকে। আমি পুরী থেকে কিনে আনা লাঠি নিয়ে বের হয়ে পরিত্যক্ত বাড়িটার সামনে যেতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। সকলে হাতা খুন্তি থেকে শুরু করে আর কত বিচিত্র হাতিয়ার নিয়ে চিৎকার শুরু করেছে। সবার মুখে মারব মারব রব। শ্যামাকান্তবাবু তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে বন্দুক উঁচিয়ে রয়েছে নারকেল গাছটার দিকে। হরিপদবাবু এলিয়েন কি সেটা বয়স্কদের বোঝাচ্ছে। কালিপদবাবু নিশ্চিত ওইটা ভূত ছাড়া আর কিছু নয় , তাই তিনি সঙ্গে করে একজন ওঝা এনেছেন। ঠিক সেই সময় সবার চোখের সামনে কিছু একটা চিচি আওয়াজ করে পরিত্যাক্ত বাড়িটা থেকে বেরিয়ে একলাফে গাছে উঠে গেল । আমাদের সকলের মারমার রব। শ্যামাকান্তবাবু চিৎকার দিয়ে বলে উঠল ‘ যেই হও তুমি বাছা নীচে নেমে এস নাহলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব।’ একজন তরুণ সাহসী সাংবাদিক তার বেশ জোড়ালো লাইট নিয়ে ছুটে গেল গাছের দিকে। তাঁর জোড়ালো আলোটা নারকেল গাছের ডালটায় পড়তেই সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইল সেই জিনিসটার দিকে। সেই জিনিসটা না এলিয়েন ,না কোন ভূত, সেইটা একটা লোমযুক্ত লম্বা লেজ বিশিষ্ট মুখপোড়া হনুমান। প্রথমে সবাই সবার মুখের দিকে তাকালো তরপর হো হো করে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়ল। হনুমানটা তাঁর ছোট দুটো চোখে আলো ফেলায় খুব বিরক্ত হয়েছে। দাঁত খিঁচিয়ে উঠছে আমাদের দিকে তাকিয়ে। না আর তাঁকে কেউ বিরক্ত করল না। ওই মুখপোড়া হনুমানটা সবার যুক্তি আর ভাবনায় কালো রঙ লেপে দিয়েছে যে। অনেকদিন পর সেই ছোটবেলায় ফিরে গেছিলাম। ছোটবেলায় হনুমান দেখলেই ‘এই হনুমান কলা খাবি জয় জগন্নাথ দেখতে যাবি?’ বলে চিৎকার করতাম। আজকেও সেটাই করতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু চেপে গেলাম। শেষে আমার নাম না হনুমান বাবু বানিয়ে না দেয় কমিটির লোকেরা সেই ভয়ে। তবে একটাই আমার প্রশ্ন বাঁদরামিটা আমরা করলাম না হনুমানটা? ।