সঠিক মানুষের সাহচর্যে এলে হয়তো সঠিক জ্ঞান লাভ করা সম্ভব, আর তাই হয়তো প্রকৃত অর্থে বিঞ্জান। বিঞ্জান মানেই শুধু পদার্থ বিদ্যা বা রসায়ণের জটিল গনণা বা সংখ্যাতত্ত্বের বিচার বোঝানো সেটা না, মানুষকে প্রকৃত ঞ্জানের সাথে পরিচিতি করানো সেটাও বিঞ্জানের মূল উদ্দেশ্য। আমার এক বন্ধু প্রসঙ্গে একটু আসি যাকে আমি একদিন কথা প্রসঙ্গে জিঞ্জেস করেছিলাম “তুই তো নবদ্বীপের মানুষ, তুই কি নিরামষভোজী? উত্তরে সে আমাকে শ্রীশ্রীচণ্ডী থেকে একটি ব্যাখ্যা প্রতিপাদন করে। বলে, ইন্দ্রনীলদা মেদিনী যদি মধু ও কৈটভ নামক দুই অসুরের মেদ ও রক্ত থেকে সৃষ্ট তাহলে সত্যি কি সেই অর্থে কোনো নিরামিষ দ্রব্য সম্ভব। স্তম্ভিত হয়েছিলাম কথাটা শুনে, কেনো বলুন তো এইভাবে আগে কেউ কোনদিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়নি সত্যিটা কি? তার মানে সবটাই আপেক্ষিক সবটাই মানুষের একটা ধারণা যাকে আমরা ইংরাজীতে বলতে পারি Perception। মানুষটি আর কেউ নন আমার প্রিয় বন্ধুর তালিকার শীর্ষ স্থান অধিকারী ডঃ প্রীতম সুকুল। নবদ্বীপ প্রসঙ্গই যখন উঠলো তখন রাধাকৃষ্ণ প্রসঙ্গ বা মহাপ্রভুর ধারণাই বা কেনো বাদ থাকে। আমরা ধর্ম মানি ঠিকই কিন্তু ধর্মীয় দেবতাদের আমরা নীচতা দেখাতেও ছাড়ি না। যতই মুখে বলি “অনাদিরাদি গোবিন্দ সর্বকারণ কারণম্”। কিন্তু দুঃখের বিষয়টা হলো যে শ্রীকৃষ্ণ আমাদের ধর্মের মূল ভিত্তি, যে গোবিন্দের মুখ নিঃসৃত সুললিত বাণী শ্রীমদ্ভবদ্গীতা রূপে আমাদের হিন্দু সমাজ আপন ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দিয়েছে আমরাই সেই পুরুষোত্তম কে নামিয়েছি কদর্যতার চরম সীমানায়। তাই সাধারণ মানুষের কাছে কৃষ্ণ বলতে পাশের বাড়ির সেই ছেলেটাকে মনে হয় যার জীবনের প্রতিটা রাত কাটে একাধিক নারীসঙ্গে অথচ গীতাতেই তিনি নাকি বলেছেন নরকের তিনটি প্রবেশদ্বার কাম, ক্রোধ ও লোভ। এখানে মনে হচ্ছে না কৃষ্ণ তত্ত্বে কোথাও রয়েছে গণ্ডোগোলের ছাপ। কোথাও শ্রীভগবানের উপর রাধারাণীর নাম জড়িয়ে অনেকটা ইচ্ছাকৃত ভাবে তাকে করা হয়েছে কলঙ্কিত। এখানে ধর্ম কিন্তু নীরব জবাব দেবে বিঞ্জান।
এবার আসি আসল প্রসঙ্গে বিঞ্জানের পর্যালোচনাতে।সময়টা তখন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অন্ধকার যুগ। তুর্কী মুসলিমরা বাংলাদেশ আক্রমণ করেছে। গৌড়ের নবাবের আদেশে বাংলাদেশের পণ্ডিতদের ঘর থেকে বের করে এনে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো পুরানো পুঁথি ও নথিপত্র। সাহিত্যসৃষ্টি কে বাঁচাতে পণ্ডিতরা এই সকল পুঁথিকে গোপনে লুকিয়ে ফেললেন, তার জায়গায় উঠে এলো কিছু এমন ধরণের লেখনী যেখানে এককথায় spiritual pleasure এর বদলে প্রাধান্য পেলো sexual pleasure। সেই গল্পের প্রধান নায়ক ও নায়িকা চরিত্র দুটি গোবিন্দ ও রাধারাণী। পদাবলীর পদকর্তারা এমনভাবে ঢেলে সাজালেন সে গল্প যা আজকের যুগের pornography এর থেকে কম কিছু নয়। নবাবের যৌন সুড়সুড়িতে রঙচড়াতে এলেন কিছু তথাকথিত পালাকার ও কীর্তনিয়ার দল। সত্যি বলুন তো আজও যখন আমরা রাধা কৃষ্ণের লীলাবিলাসের পর্যায়ের কীর্তনগুলি শুনি সেখানে মনে হয় না কৃষ্ণ একজন পুরুষ ও রাধা একজন নারী। সেখানে মনে হয় না এদের সম্পর্কের মূল ভিত্তি ভূমি sexual pleasure, সত্যি আমাদের কখনও শ্রীরাধা ও কৃষ্ণের দেহাতীত প্রেমের কথা আমাদের কারো চিন্তায় আসে? বললে একটু অন্যরকম শোনালেও কীর্তনের সেই sexual pleasure কে উপভোগ করা জন্যই কিন্তু বেশীর ভাগ মানুষ কীর্তন আজও শুনতে যান। ভাবতে সত্যি অবাক লাগে আমার মতই একই ধারণা কিন্তু পোষণ করেন নবদ্বীপের বিখ্যাত ভাগবৎ কথাকার ও পণ্ডিত মাননীয় শ্রী গোরাচাঁদ ভট্টাচার্য্য মহাশয়ও।আরো অবাক করা বিষয় কি জানেন এই একই তত্ত্বের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু স্বয়ং। এখানেই আমার লেখার মোড় নেবে অন্যদিকে। অনেক বড় বড় বৈষ্ণব পণ্ডিতগণ হয়তো রে রে করে আমাকে মারতে আসবে আর অকথা কুকথা ভরা গালমন্দ করতে ছাড়বেন না কিন্তু মহাপ্রভুর সেই বিঞ্জানের চোখ দিয়ে দেখলে বুঝতে পারবো সত্যিটা সত্যি। আলোচনার প্রসঙ্গে তুলে আনি শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের রায় রামানন্দ সংবাদ অংশটি।
মহাপ্রভু এসেছেন রায় রামানন্দের কাছে। তিনি প্রশ্ন রাখলেন যে রামানন্দ বলো এই কৃষ্ণ যাকে বিষয়রূপে নির্দিষ্ট করে রাধারূপী কান্তার প্রেম আবর্তিত হয় সেই কৃষ্ণই বা কে আর সেই রাধাই বা কোনজন? আমি জানি একমাত্র তুমিই দিতে পারবে এই সঠিক তত্ত্বের ব্যখ্যা। পাঠকগণ স্বভাবতই একটি প্রশ্ন আমাদের সকলের মধ্যে উঠে আসে নবদ্বীপের মানুষ হয়ে, এত বড় পণ্ডিত হয়ে, এতো পদাবলী কীর্তন শুনে সত্যি কি মহাপ্রভু বুঝতে পারেননি শ্রীরাধা কে বা গোবিন্দই বা কে? কেনো তিনি রায় রামানন্দকে জানতে চান:কৃষ্ণের স্বরূপ কহো রাধিকার স্বরূপরস গুন তত্ত্ব প্রেম গুন তত্ত্বরূপ
তার মানে? মহাপ্রভু বুঝতেন ধর্ম ও পদাবলীর নামে মানুষকে যা বোঝানো হয় বিঞ্জান কিন্তু অন্য কথা বলে। এই কেনোর উত্তর পেতে গেলে আমাদের আগে বুঝতে হবে এই রায় রামানন্দ মানুষটি কেমন? রায় রামানন্দ তখন এসেছেন নীলাচলে। কৃষ্ণ তত্ত্ব ও শ্রীরাধিকা তত্ত্ব শোনার আকুলতায় মহাপ্রভু প্রদ্যুম্ন মিশ্রকে পাঠান রায় রামানন্দের কাছে। তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন রায় রামানন্দ কয়েকজন জগন্নাথের দেবদাসীর দেহে উদবর্তন লেপন করছে। এই সকল দেবদাসীগণ সম্পূর্ণা নিরাভরণা গায়ে তাদের বস্ত্রের লেশ মাত্র নেই। রায় রামানন্দ আনন্দিত চিত্তে তাদের অঙ্গ মার্জনা করছেন কারণ সন্ধ্যাবেলায় প্রভু জগন্নাথের সামনে অনুষ্ঠিত হবে জগন্নাথ বল্লভ নাটক। রায় রামানন্দ নির্বিকার কোন চেতনা বা উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ নেই তার মধ্যে। প্রদ্যুম্ন মিশ্র এসে তীব্র ক্ষোভে মহাপ্রভুকে সম্ভাষিলেন হে প্রভু এ তুমি কার কাছে গোবিন্দ ও শ্রীরাধা রাণীর তত্ত্ব ব্যাখ্যা শুনতে চেয়েছো? মৃদু হেসে মহাপ্রভু যে প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করেছিলেন সেটি বড় মনোরম। মহাপ্রভু বুঝিয়েছিলেন কলিযুগে এই জগতের মূল ভিত্তি হলো কাম যার দ্বারাই নরনারী লিপ্ত হয় যৌন সম্পর্কে। এই Sexual pleasure ই কলির সকল আকর্ষণের মূল কেন্দ্র বিন্দু। কিন্তু দেবতার পূজা নিবেদনের আগে যেমন বাসন পত্র মার্জন করতে হয় তেমন উন্মুক্ত নারী দেহ কে শ্রীজগন্নাথের পূজার উপকরণ ঞ্জানে যিনি সাজাতে পারেন ভগবানের উদ্দেশ্যে তিনিই একমাত্র বলতে পারেন রাধা কে আর কৃষ্ণই বা কে? প্রকৃত অর্থে তারই সেই চৈতন্যদয় হয়েছে যার কাছে বিবস্ত্রা সুন্দরী রমণীদেহ শ্রী জগন্নাথের পূজার উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে কীর্তন শোনার আনন্দে যার মনের ভাব এটাই থাকে যে রাধা একজন নারী এবং কৃষ্ণ একজন পুরুষ এবং তাদের আকর্ষণ ও আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু শুধুই sexuality তাহলে চোখ থাকতেও সেই ব্যক্তি অন্ধ তিনি যত ঞ্জানী হোন না কেনো। সে কি করে বোঝাবে রাধা কৃষ্ণ তত্ত্ব বলুন তো। কারণ গল্প করে বা গান গেয়ে লৌকিক কথা অনুসারে লীলা বিলাসের কাহিনী তার পক্ষে হয়তো বলা সহজ কিন্তু সেই তত্ত্ব ব্যাখ্যাতে সত্যিই সেই ব্যক্তি অপারগ। সুতরাং এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা তখনই সম্ভব যার কিঞ্চিৎ সেই উপলব্ধি হয়েছে। দুঃখের বিষয়টা এই যে আজও বৈষ্ণব সমাজে মহাপ্রভু ও রায় রামানন্দ সংবাদ সেই ভাবে সঠিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয় না। যে কারণে আসল তত্ত্বই থাকে চির অধরা। আর শুধুমাত্র রাধা ও কৃষ্ণকে নরনারী ঞ্জানে চিন্তা করে মানুষ নিজেকে ঠেলে দেয় আরো বেশী অঞ্জানতার অন্ধকারে।
এতো ভালোবাসা নয় ভালোবাসা নয়
কামনা জড়ানো চাওয়া।
আঁধারের পথে ঘুরে ঘুরে এসে
আঁধারেতে মিশে যাওয়া।।
মহাপ্রভু এই বিঞ্জানকেই জনসমক্ষে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন দেহজ প্রেম যা কাম রূপে আমাদের অন্তরে বিদ্যমান সেই ভাব তত্ত্ব গোবিন্দ ও রাধারাণীকে চেনা যায় না। যে প্রেম দেহাতীত যা pletonic love রূপে পরিচিত যদি সেই তত্ত্বে উপনীত হওয়া যায় তাহলেই এই স্বরূপের উপলব্ধি সম্ভব। এটাই দেহাতীত কাম যা আক্ষরিক অর্থে প্রেমরূপে বিদ্যমান। ভাগবতে তাই রাধাকে পাওয়া যায় না। কারণ রাধারাণী তো শুধুই সেই প্রেম বা সেই উপলব্ধি মাত্র যাকে অবলম্বন করে প্রাণপ্রিয় গোবিন্দকে লাভ করা সম্ভব:
শ্রী রাধা উবাচ
অহমেব পরমব্রহ্ম পুরুষ শ্যামবিগ্রহ
অহম সা পরাশক্তি শ্রীমৎ ত্রিপুরসুন্দরী।
প্রসঙ্গতঃ কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে আঘাত করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয় সীমিত জ্ঞানের এই লেখা শ্রী রাধামাধবের চরণে আমার ভক্তিপূর্ণ পুষ্পাঞ্জলি।
প্রণমান্তে
ইন্দ্রনীল