নির্ঝরিণীর পরিজন - অঞ্জলি দে নন্দী, মম
বাঁকুড়ার অজ পাড়া গাঁ। একটি মাটির ঘর। টিনের দোচালার ছাউনি। ভদ্রলোক সরকারী প্রাইমারী স্কুলের হেড স্যার। এছাড়াও জয়রামবাটীতে একটি তেলের ঘানি আছে। বিরাট সংসার। শুধু কী আর ঐ মাস মাইনের ক’টা টাকায় সংসার চলে? তাই এই ব্যাবসা করা। স্কুলের ছুটির পর ও স্কুল শুরুর আগে এখানে থাকে। তাছাড়া স্কুল যখন বন্ধ থাকে তখন সারা দিনই ঘানিতে থাকে। প্রতি রবিবারে এবং গ্রীষ্মের ও পুজোর ছুটির সময় – এক ও এক দুমাস। ভদ্রমহিলা প্রচন্ড পরিশ্রমী হলেও এই বিশাল সংসারের ঘানি টানা কি চাট্টিখানী কথা? তাই একজন উপজাতী রমণীকে বাড়ীতে সারাদিনরাত কাজের জন্য রাখা হয়েছে। সে এখানে থাকে, খায় ও বস্ত্রের খরচও মালিকেরই। পাঁচটি মেয়ে ও তিনটি ছেলে আর বাবা, মা ও এই মেড নিয়ে এদের সংসার। এক কুটুরী মাটির ঘরের তবে একটি বিরাট দুয়ার ও তার পর এক বিরাট উঠোন আছে। দুয়ারটা টিনের ছাওয়া তবে উঠোনটা খোলা আকাশের নীচে। সেখানেই খাটিয়া পেতে পুরুষরা রাতের সময় ঘুমোয়। মহিলারা ঘরের ভেতরে। উঠোনের ওপাশে, এক বিশাল গোয়াল। সেখানে সাতটা মোষ, ন’টা গরু ও খান পঁচিশেক হাঁস আছে। দুধ ও ডিম বাড়ীতে নিত্য ক্রেতা এসে নিয়ে যায়। মেডই বেশিরভাগ সময় এদের দেখাশোনা করে। রাতে সবার আগে বাবামা গোয়ালে যায়। মা কেরোসিন তেলের লণ্ঠন জ্বেলে হাতে সেটি ঝুলিয়ে গোয়ালে যায়। কারেন্ট তো গ্রামে এসে পৌঁছয় নি। সাথে বাবা থাকে। এখানে গিয়ে এরা সব মোষ ও গরুর প্রতিটি ক্ষুরে হাত লাগিয়ে সে হাত আবার নিজেদের যে যার মাথায় ঠেকায়। আর হাঁসেদের বিরাট বিরাট ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখা থাকে। সেগুলির চারদিক দিয়ে মনে মনে নিজেদের গুরুমন্ত্র জপ করতে করতে ডান হাতের মধ্যমা অঙ্গুলি দিয়ে দুজনে অদৃশ্য মন্ত্র গন্ডি কেটে দেয়। রোজ এসব করে যখন ঘরের দুয়ারে এসে বসে তখন প্রতিটি সন্তান ওই ঘানির সর্ষের তেল দিয়ে বাবা ও মায়ের পায়ে মালিশ করে। এরপর সবাই শুয়ে পড়ে।
এদের প্রচুর ক্ষেত জমী আছে। চাষবাস ভালোই হয়। আলু চাষের সময় বাবা টাকা ও খাবার দিয়ে কৃষাণ চাষ করালেও, পরিবারের সদস্যরা সবাই চাষের কাজে লাগে। রাত্রে হ্যাসাক জ্বেলে উঠোনে সবাই এক একটা করে বিশাল বিশাল বোঁটী নিয়ে তাতে আলুর কল সমেত অংশগুলি কাটে। প্রায় সারারাত আলু কাটা হয়। বোঁটীগুলি এদের নিজেদের। কামারশালা থেকে বানানো। সকালে পুরুষরা গোয়াল থেকে হাল ও হেলে নিয়ে গিয়ে জমি লাঙ্গল দিয়ে চাষ করে ও কাটা কল সমেত আলুর টুকরোগুলোকে মাটির নিচে বসিয়ে তারপর মাটি চাপা দিয়ে দেয়।
দুয়ারে গায়ে গায়ে লাগানো, পাশাপাশি ছ’টা মাটির বড় বড় উনুন। এখানে কাঠের জ্বালে রোজ রান্না হয়। মেড, মা ও মেয়েরা সবাই রান্নায় হাত লাগায়।
ঘরের ভেতরে বাঁশ চেরা অৰ্থাৎ বাখারী দিয়ে পেরেক দিয়ে শয্যা তৈরি করা আছে। পায়াগুলি মাটির মেজেতে গাড়া আছে। এই মাচানের ওপরে মেডের হাতে সেলাই করে তৈরি করা, বাড়ির মহিলাদের পুরোনো বাতিল শাড়ি ও বাবার ধুতি দিয়ে কাঁথাগুলি পাতা আছে। মাথার বালিশ হচ্ছে ছেঁড়া জামা কাপড়ের বুঁচকী। ঘরের কোনো জানলা নেই। বাঁশের বাখারী দিয়ে বানানো, দরজা। এর নাম আগোর। মোটা একটা দড়ি দিয়ে এটিকে ভেতরের মাটির দেওয়ালে আটকানো একটি হাঁসকলে বেঁধে দিয়ে, ঘর বন্ধ করে মহিলারা ভেতরে রাতে ঘুমোয়।
এই মহিলারা সূতির শাড়ী ছাড়া কিছুই পড়ে না। বাবা সূতির ধুতি ও পাঞ্জাবী পড়ে। পুরুষেরা, যারা স্কুলের তারা হাফ প্যান্ট ও শার্ট পড়ে। বড়রা পায়জামা ও শার্ট পড়ে। মহিলাদের লম্বা কেশ।
বড় মেয়েটি টেন পাস করলো। পাশের গ্রামের এক সরকারী হাই স্কুলের টীচারের সঙ্গে দেখে শুনে, পণ দিয়ে বাবা বিয়ে দিয়ে দিল। মেজোও যখন বি. এস. সি. পাস করলো, এক সরকারী কলেজের প্রফেসরের সঙ্গে দেখে শুনে, পণ দিয়ে বাবা বিয়ে দিয়ে দিল। সেজো মেয়েটা ক্লাস সিক্স ও এইটে স্কলারশিপ পেলো। কামারপুকুর রামকৃষ্ণ মিশনের স্যারের কাছে পড়ত তো তাই। ওনাদের শিক্ষা তো অতি উত্তম! টেন পাস করলো খুব ভালো নাম্বার পেয়ে। এদিকে সে ক্লাস সিক্স থেকে একজনের সঙ্গে প্রেম করে। ছেলেটি কলকাতার। মিশনে থেকে পড়ে। সেও ওই স্যারের ছাত্র। একসঙ্গে পড়তে পড়তে প্রেম। ও ও খুব ভালো রেজাল্ট করলো। এক বয়সী ও একই ক্লাসের ওরা। তবে স্কুল আলাদা আলাদা। মেয়েটির বড়দা কলকাতার একটি কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্সের ছাত্র। ও ও হোস্টেলে থাকে। মেজদা কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। ওখানেই থাকে। এবার মেয়েটিকে তার মেজদা কলকাতার বেথুন স্কুলে বারো ক্লাসে ভর্তি করে দিল। ভালো নাম্বার তো তাই চান্স পেয়ে গ্যালো। হোষ্টেলে থেকে পড়ে। বারো ক্লাসে পড়ার সময় ওর প্রেমের ব্রেক আপ হল। ওদের গ্রামের পাশের বাড়ির একটি ছেলের সঙ্গে তখন নতুন প্রেম হল। ও ও কলকাতার আর. জী. কর. কলেজে ডাক্তারী পড়ে। ছুটির সময় ওরা দুজন একসাথে কলকাতা থেকে গ্রামে আসা যাওয়া করত। ক্রমশ প্রেম। বারো ক্লাসে মেয়েটি খুব খারাপ রেজাল্ট করল। গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে ভালো রেজাল্ট করা চারটিখানি কথা নয়! এবার ও রামমোহন কলেজের হোস্টেলে থেকে ফিজিওলজি অনার্স নিয়ে পড়লো। হোষ্টেল রুল অনুসারে, প্রেমিককে মেজদা ওর লোকাল গার্জেন করে দিল। সপ্তাহে দুদিন বিকেলে সে লেডিস হোষ্টেলের ভিজিটিং হলে এসে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করে। আবার মেজদাও আসে। ওদিকে গ্রামে ওর পরের বোনটিকে বাবা ওই দিদির প্রেমিকের ভায়ের কাছে প্রায়ই পড়তে পাঠায়। মেয়েটি স্কুল ছাত্রী। কিশোরী। সবে তার নারী অঙ্গ বর্ধিত হতে শুরু করেছে। একটি হাল্কা টেপ ফ্রক পড়ে মা ওই ছেলেটির বাড়িতে পড়তে পাঠায়। এরা তিন ভাই। বড়টি আলুর স্টক ব্যাবসা করে। মেজটি ডাক্তারী পড়ে। আর এ হল ছোট ছেলে। এ খড়গপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। যখন বাড়ি আসে তখন ওকে পড়ায়। বাবা ও মা আছে। বাবা চাষ করে। বেশ ভালোই জমী আছে। মাটির দোতলা বাড়ি। এরা আবার শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়। মা তো সিধাসাধা। তো যা হয়! মেয়ের বাবামায়ের পাঠানো ফাঁদে ইঞ্জিনিয়ার ছাত্র পড়লো। প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। মেয়েটি দেখতে ও পড়ায় আদৌ ভালো নয়। কিন্তু যুকবকে টলানোর জন্য তো ও সব লাগে না। তো ও যখন খড়গপুর হোস্টেলে থাকে রোজ একটি করে চিঠি লিখে একে পাঠায়। আর এ সপ্তাহে একটি করে পাঠায়। ক্রমে বারো ক্লাস পাস করলো। এবার আরামবাগ কলেজে ফিলজফি অনার্স নিয়ে ভর্তি হল ও হোস্টেলে থাকে। ছোট ভাইটিকে গ্রামের স্কুল থেকে বারো ক্লাস পাসের পর, বাবার চেনা জানা কাউকে ধরে বেলুড়ে ফিজিক্সে অনার্সে ভর্তি করালো। কিছুদিন যেতে না যেতেই সেও একটি মেয়ের প্রেমে পড়লো। বেলুড়েরই। আর মেজদা তো কলেজে পড়ার আগে পাশের গ্রামের একটি সম বয়সী মেয়ের সঙ্গে প্রেম করত। মেয়েটির দাদা ওখানকার এক কলেজের প্রিন্সিপাল। পরে ডাক্তারী পড়ার সময় তাকে ছেড়ে দিয়ে আবার একটি ডাক্তারী পড়া ক্লাস মেটের সঙ্গে প্রেম করলো। ছোট বোনটি গ্রামের স্কুলেই পড়ে।
বড়দা এম. সি. পাস করে ব্যাঙ্গালুরুতে রিসার্চ করল। ডক্টরেট হয়ে গেল। এবার বাবামা দেখে শুনে হুগলীর শেলালপুর গ্রামের একজন পাত্রীকে পছন্দ করল। সে পলিটিক্যাল সায়েন্স-অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন করেছে। মাবাবার একই সন্তান। বাবা ব্যাবসাদার। মা হাউস ওয়াইফ। বিরাট একটি পাকা তিন তলা বাড়ি আছে। পণ নিয়ে বিয়ে হল। বউকে নিয়ে বর ব্যাঙ্গালুরু চলে এলো। পরে সে সায়েন্টিস্ট হল। বউটি হাউস ওয়াইফ।
ওদিকে ইঞ্জিনিয়ার তো উত্তর প্রদেশের কানপুর থেকে এম. টেক. পাস করে, ব্যাঙ্গালুরুর একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে জব নিল। এদিকে ওর প্রেমিকা বিয়ের অপেক্ষা করছে। সে গ্রাজুয়েট হয়ে গেছে। তবে এম. এ.-তে চান্স পায় নি। তাই মেজো ভাই বলল,
” বাবা আমি তো জব করছি এবার বিয়ে করব। ”
বাবা – তোর মেজদার বিয়ে হোক। তারপর তোর।
বড়দা ও বৌদিও তাই বলল। এদের তো তিনটি মেয়ে আছে। কিন্তু ও বলল,
” ও তো এখনও লেখা পড়ার গন্ডিই ডিংগোয় নি। কবে চাকরী পাবে। তারপর বিয়ে করবে। আমি ক্যানো এতোদিন দেরী করবো? ” হ্যাঁ ও তখন এম. ডি. করছে। টাকা যা পায় তাতে বিয়ে করাই যায়। কিন্তু ও জব করে তারপর বিয়ে করবে।
আসলে মেজটি বি. এস. সি. পাসের পর ডাক্তারীতে চান্স পায়। তাই একটু লেট তো হয়েইছে। ওর প্রেমিকা তখন এম. এস. সি. পড়ে। তো ও ঠিক করলো বিয়ে করবে। এর তো খুব প্রেম। যখন বাইরে থেকে গ্রামে আসতো তখন নিজেদের বাড়ি আগে না ঢুকে প্রেমিকার বাড়ি ঢুকে খেয়ে দেয়ে, প্রেমিকার সঙ্গে মিলে মিশে কয়েক ঘন্টা পর তারপর নিজের বাড়ি গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করত। দুজনের বাড়ির মাঝে একটি জমি আছে শুধু। দু ভাই ও দু বোন একই দু পরিবারের প্রেমের পাত্র ও পাত্রী। মেয়েদের বাবা এবার ওই পুরোনো ঘর ছেড়ে দিল। নিজেরই পাশের জমটিতে একটি দোতলা মাটির বাড়ী বানালো। নীচে চারটি ও ওপরে চারটি ঘর। নীচে বিরাট দুয়ার। ওপরে লম্বা বারান্দা। টিনের চাল। বাথরুম ও পায়খানাও করলো। এর আগে ওরা পুকুরে স্নান ও মাঠে মল ত্যাগ করত। পুরো বাড়ির সামনে বিরাট আঙিনা। সারা এরিয়াটা মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রেমিকাদের নিজেদের জমীর ওপরে বাড়িটি। কিন্তু উঠোন ও বাউন্ডারি ওই প্রেমিকদের জায়গায় জবর দখল করে প্রেমিকাদের বাবা নিয়ে নিয়েছে। ওরা লড়েছে কিন্তু পেরে উঠে নি। তাই বিনা মূল্যে দিয়ে দিতে হয়েছে। এরজন্য প্রেমিকরাও কোনদিন প্রেমিকাদের কিছু বলে না।
দুর্গা পূজার সময় এদিকে প্রেমিকদের নব বস্ত্র কিনে উপহার দেবার জন্য প্রতি বছর প্রেমিকাদের বাবা অনেক টাকা দেয় প্রেমিকাদের হাতে। ওরা গরিয়াহাট, কলকাতা থেকে কিনে উপহার দেয়। আইবুড়ো জামাইদের হাতে তো রাখতে হবে না! এসব ঘুষ তো দিতেই হবে।
তা এবার ইঞ্জিনিয়ার তো বিয়ে করে ফেললো। অনুষ্ঠান হল। পণ নিল না। বিয়ে করে পত্নীকে নিয়ে ব্যাঙ্গালুরু এলো। এরপরের বছর আমেরিকায় জব নিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে চলে গ্যালো। এ বউ ভালো করে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারে না। আমেরিকার বাসিন্দা হল সে। একেই বলে বোধ হয় সৌভাগ্য।
এদিকে মেজো পাস করে চাকরী না করে নিজে ডিস্পেন্সারি খুলল। ও চাইল্ড স্পেশালিষ্ট। তো এবার এ বিয়ে করলো। বিয়ের পরের বছর ওদের একটি মেয়ে হল। কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকত। এবার মা ও মেয়েকে গ্রামে জা, ভাসুর, শ্বশুর, শাশুড়ি ও জায়ের মেয়েদের কাছে রেখে এলো। তখন ও পাশেই মাবাবার বাড়ি এসে রইল। আর কাছাকাছি এক জায়গা থেকে বি. এড. করতে লাগলো। এম. এস. সি. তো কলকাতা থেকে পাস করেছে। তখন তো হোস্টেলে থাকতো। পাসের পরই তো বিয়ে হল। তা যা হোক- প্রতি মাসে একরাতের জন্য বর গ্রামে আসে। তখন ও শ্বশুর বাড়িতে থাকে। আবার বর চলে গেলে বাবার বাড়ি চলে আসে। তো বড় মেয়েটি কয়েক মাসের হতে না হতেই ও নিজের অজান্তেই আবার প্রেগনেন্ট হল। এদিকে ওর মেজদা এক প্রাইভেট নার্সিং হোমে ডাক্তার হিসেবে জয়েন করেছে। ও ও স্পেশালিষ্ট। তো নির্ঝরিণী এবার কি করে? বরকে বলল,
এবরশন করিয়ে দাও!
বর- তোমার মেজদাকে বলে করিয়ে নাও!
আসলে ও মেজদাকে খুব ভালোবাসে। তাই বর সহ্য করতে পারে না। তাই বলল।
তো ও এবার মেজদাকে বলল। সে বলল,
” দরকার নেই। আমাদের মাবাবার কাছে থাক! ডেলিভারি হবার সময় আমি তোকে কলকাতায় আনবো। আমার নার্সিং হোমেই হবে। ”
তাই হল। এবারেও মেয়ে হল।
ওদিকে ওর মেজদা যখন ও এম. এস. সি. পড়ত তখন তার হোস্টেলে যেত। তাই ওরই এক রুম মেট, সে ফিজিক্সে মাষ্টার্স করছে, তার সঙ্গে প্রেম করলো। আগের ডাক্তারকে ছেড়ে দিল। যে হল এর তিন নাম্বার প্রেমিকা। সে এম. এস. সি. ও বি. এড. পাস করে কলকাতার এক সরকারী স্কুলে টীচারী করে। একে এবার মেজদা বিয়ে করলো। পরে এদের এক ছেলে হল।
ওদিকে বড় বৌদীর বাবামা শেলালপুর গ্রামে একা একা থাকে। মেয়ে ও জামাই ব্যাঙ্গালুরু থেকে এসে একটি চব্বিশ ঘন্টার মেড রেখে গেছে। কিন্ত ও বৃদ্ধা ও বৃদ্ধকে যত্ন করে না। প্রায়ই নিজের বাড়ি পালায়। এরা বিছানায় শয্যাশায়ী। বেশিভাগ রাতে ওরা মল মূত্র সারা গায়ে মেখে পড়ে থাকে। মেয়ে ও জামাই চেষ্টা করেছিল, কাছে এনে রাখার। কিন্তু ওরা আসে নি। পরে প্রথমে বাবা ও তার এক বছর পর মা মারা যায়। বাড়িটি তালা লাগিয়ে রেখে গেছে, মেয়ে ও জামাই। ওরা এসে এদের শেষ কাজ করে গেছে। মরে পড়ে ছিল। মেড আসে নি। পাড়ার কেউ বুঝতে পারে। এসে দ্যাখে। বাবা মরে গেছে। আর মা তো প্যারালাইসিস। সে কথা বলতে, নড়তে পারে না। কাউকে ডাকবে কি করে? বাবাও তাই। প্যারালাইসিস হয়ে পড়েছিল। পরে মা যখন মরে তখন পাড়ার সবাই সামনেই ছিল। মেয়ে ও জামাইকে পাড়ার মানুষই খবরাখবর দ্যায়। মারা যাওয়ার পর, ওরা খুব কম আসে এখানে। ওদের আবার এতদিনে একটি ছেলেও হয়ে গেছে।
আর যারা ইউ. এস. এ.- তে তারা বাচ্চা নেয় নি। মস্তি করছে। সেখানে আবার ফ্ল্যাটও কিনে নিয়েছে।
মেজদাও বিয়ের কয়েক বছর পর কলকাতায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছে।
নির্জরিণী দু মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি আছে। ডেলিভারি হয়ে গেলে মেজদা আবার গ্রামে রেখে গেছে। এবার বর একটি ফ্ল্যাট কিনলো। চব্বিশ পরগনায়। সেখানে বউ, মেয়েদের ও নিজের মাবাবাকে নিয়ে গ্যালো। সবাই এখন এখানে একসঙ্গে থাকে। শ্বশুর ও শাশুড়ি এবং বর এবার প্রতিশোধ নিতে লাগলো এখন। ওর বাবা যে জমী মেরে নিয়েছিল তখন। সব সময় বউকে দিয়ে দুজনে পা টেপায়। মেয়েরা বড় হল। ওদেরকে দিয়েও করায়। এর এতো বিদ্যা এই কাজে লাগছে।
ওদিকে গ্রামে বাবা পা ভেঙে পড়ে আছে। ক্রমশ বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে গেল। প্রস্রাব করে ফেলছে। মা করছে। মেড তো আছেই।
ওর বড় ভাসুর এদের আর ভিটাতে উঠতে দেয় না। তিন মেয়ের একজন আবার বোবা।
ছোট ভাইটি গ্রাজুয়েট হয়ে, প্রেমিকাকে বিয়ে করে। ঘর জামাই হয়ে গেছে। শ্বশুরের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে।
ওদিকে যখন ছোট বোনটি গ্রাম থেকে বি. এ. পাস করেছে তখন একটি রেখে চাকরী করা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দ্যায় বাবা। ওরা বর্ধমান শহরে আছে।
নির্জরিণীর সঙ্গে এদিকে ওর হোস্টেলের এক সময়ের রুম মেট আর এখনের মেজো বৌদীর খুব ঝগড়া হল। এর বাবার বাড়ি মুর্শিদাবাদ। আগে ওর বাবা ও মা ঢাকা, বাংলাদেশে থাকতো। পরে ভারতে আসে। এরা ঘটি। আর ওরা বাঙাল। যাক তো – দাদা ও বৌদীর সঙ্গে তাই কোনও সম্পর্ক নেই আর। এর মেয়েরা এবার বড় হল। দুজনেই কলকাতার কলেজে ডাক্তারী পড়ছে। আর ও বেকার। খানিকটা মানসিক রোগও এসে গেছে। জীবনের ডিগ্রীগুলি যে বৃথা হয়ে গেল।
ওদিকে অনেক বছর পর – পর পর দু মেয়ের মা হল ও আমেরিকাতে। দু মেয়ের বয়সের তবে অনেকটাই তফাৎ। জানা যায় নি যে ওখানে ওই ছেলে বউয়ের ওপর নিজের বাবার হয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে কি না? ! ……
নির্জরিণীর লেখাপড়া হারিয়ে গ্যালো প্রেমের মরীচিকায়…..
ওর ছোট মেয়েটি আবার দারুন ঝগড়াটে। বড় দিদির সঙ্গে খুব অশান্তি করে। তার চোখের দৃষ্টি শক্তিও ভালো নয়। এই মেয়েকে নিয়ে বর ও নির্জরিণী সারা ভারতের যেখানে যত আই স্পেশালিষ্ট আছে চিকিৎসা করাচ্ছে। তবে পরে ও পুরো অন্ধ হয়ে যাবে। এরকমই ডাক্তারগণ বলছেন। ও বলেছে,
” মা! দিদি বিয়ে করে চলে যাবে। আমি সারা জীবন তোমার কাছে থাকবো। ” নির্জরিণী চুপ থাকে।