বংশীধর - সৌরভ নস্কর
ভোরবেলা পরিচিত বাঁশির সুরে ঘুমটা ভেঙে গেল ইন্দিরার। জাগতিক সপ্তসুরের বাইরে সে যেন অন্য এক সুর। সেই সুরের উৎস সন্ধানে জীবনে বহুবার ছুটে গিয়েও কখনও সেই বংশীধারীর দেখা পায়নি। ছোটবেলায় সুরটিকে অমঙ্গলের সুর মনে হত তার, কারণ সেই সুর শুনলেই তার কোনো বিপদ হত। বড় হতে বুঝেছিল সেই বাঁশির সুর আসলে তার জন্য সাবধান বাণী, কোনো বিপদের পূর্বাভাস, এক অদৃশ্য রক্ষাকবচ। কতবার সেই সুরস্রষ্টার দেখা পাবার জন্য মাথা ঠুকে চোখের জলে ভাসিয়েছে। কিন্তু সে দেখা দেয়নি। শুধু একবার স্বপ্নে বলেছিল “জীবনের অন্তিম মূহুর্ত যখন ঘনিয়ে আসবে তখন আমার দেখা পাবে”।
তবে আজ সেই বাঁশির সুরের কারণ কি? সে তো এসেছে তার প্রিয়তমের সঙ্গে হানিমুনে। এখানে কিসের বিপদ? এমন সময় বান্ধবী তৃণার ফোন এলো।
কিরে বরের সঙ্গে তো বেশ এনজয় করছিস। তা বর ঠিকঠাক আদরটাদর করেছে তো?
তুই থামতো তৃণা, তোর ফাজলামি আর গেলোনা। বর সারারাত নাক ডেকে ঘুমিয়েছে।
আচ্ছা পরে কথা হবে। সাবধানে থাকিস, এনজয় ইয়োর ট্যুর, বাই।
-ফোনটা কেটে দেয় তৃণা।
সকালের কুয়াশাভেদী রোদ আর পাখির কিচিরমিচির ডাকে বাঁশির সুরের কথা ভুলে গেল ইন্দিরা। প্রফুল্ল চিত্তে বাইরে বেরিয়ে এল সে। চকৌরির এই হোটেলটা একেবারে নির্জন জায়গায়। আশেপাশে না আছে কোন হোটেল, না আছে গেস্টহাউস। আগে জানলে এই হোটেলটা বুকই করতে দিতনা। সামনে তুষারশুভ্র হিমালয় দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। কিছুটা বিস্তৃত সমতল পেরিয়ে এগিয়ে গেল সে খাদের দিকে। ঠিক এই সময় পিছন থেকে একটি পরিচিত কন্ঠস্বরে ফিরে তাকালো ইন্দিরা এবং যা দেখলো তাতে তার বিস্ময়ের অন্ত রইল না।
একি! তৃণা তুই এখানে? কবে এলি? কই আমাকে জানালি না তো?
তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিচ্ছি ডার্লিং।
কথাটি বলতে বলতে তৃণার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল তন্ময়।
শুভকাজটা সকালেই সারবো বলে আমিই ওকে ডেকে এনেছি।
কি শুভ কাজ তন্ময়?
ঐ গভীর খাদে এক্ষুণি রামধনু উঠবে। চলো তোমাকে রামধনু দেখিয়ে আনি। কি হলো চলো।
এক পৈশাচিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো তন্ময় আর তৃণা। ওরা দুজনে ইন্দিরাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল খাদের আরও কাছে।
একি কি করছো, ছাড়ো আমাকে ভালো হবেনা কিন্তু, ঈশ্বর আছেন, তিনি তোমাদের ক্ষমা করবেন না। ইন্দিরার প্রাণভিক্ষা উপেক্ষা করে ওরা ঠেলে ফেলে দিল গভীর খাদে।
বংশীধর তুমি কোথায়? আমি যে খাদে তলিয়ে যাচ্ছি।
তুমি তলিয়ে যাওনি ইন্দুলেখা, এইতো তুমি আমার কোলে। জগৎ সংসার যে ধারণ করে রেখেছে তার সখীকে কি কেউ তলিয়ে দিতে পারে?
তবে তুমিই কি সেই বংশীধর প্রভু? ছোট থেকে যাকে জল না দিয়ে নিজে জল স্পর্শ করতাম না সেই কি তুমি?কিন্তু প্রভু আমি তো ইন্দিরা, ইন্দুলেখা তো নই আমি।
তুমি হলে আমার অষ্টসখীর এক সখী গো, ইন্দুলেখা।
তাই যদি হয় তবে নিয়ে চলো আমাকে তোমার বৈকুণ্ঠধামে। তোমার শ্রীচরণে ঠাঁই দাও।
তবে তাই হোক। কিন্তু তার আগে ঐ পাপীদের শাস্তি হোক।
অকস্মাৎ পাহাড় জুড়ে আবার জমাট বাঁধল কুয়াশা। দিকভ্রান্ত হয়ে তন্ময় আর তৃণা পা বাড়ালো হোটেলের দিকে। কিন্তু দুই পা এগোনোর পর তাদের পা আর মাটি স্পর্শ করলো না।
Tags: The Indian Rover