বন্ধু তোমায় - শুভজিৎ চট্টোপাধ্যায়
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ভেজা শহরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনটা খারাপ হয়ে গেল চন্দ্রিমার।
ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। এই ব্যালকনিটাতে দাঁড়ালে অনেকটা দূর অবধি দেখা যায়। বিস্তৃত সড়ক, উড়ালপুল— সব এখন শুনশান। এ লকডাউন যে আর কতদিন চলবে..! চন্দ্রিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এই আবাসনের দু’খুপরির ফ্ল্যাটে একাই থাকে চন্দ্রিমা। চল্লিশোর্ধ বয়সে কোনো কিছুর অভাব না থাকলেও, এই নিঃসঙ্গতার হাতছানি তাকে বড্ড পীড়া দেয়। দীর্ঘ চার-পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিন ডিপ্রেশানের ওষুধ গিলে তাকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। মলয়ের সঙ্গে ডিভোর্সটা হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এইসব রোগ আরও যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
আগে তবুও বাইরে বেরোনোর একটা স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু এখন এই বন্দি জীবন…।
কত আর সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে থাকবে? ফোন করে সময় কাটানোর লোকও আর কোথায়? চন্দ্রিমা দেখেছে মা-বাবা চলে যাওয়ার পর বাকি সম্পর্কগুলোও কেমন যেন ঢিলে-ঢালা হয়ে গেছে। নিজের মানসিক দুঃখ, অবসাদ ভাগ করে নেওয়ার জন্য ওর কোনো বন্ধু নেই। সবাই তাকে এড়িয়ে যেতে চায়। ফোন করার প্রয়োজনীয়তা দেখায় না তেমন। চন্দ্রিমার স্মার্টফোনের রিংটোনে আর বেজে ওঠে না চন্দ্রবিন্দুর গান— ‘বন্ধু তোমায়…’ ।
অথচ ফেসবুকে কিছু পোস্ট করলে লাইক, কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়। আচ্ছা, যারা এত লাইক দেয়, কমেন্ট করে, ওরাও তো বন্ধু, নাকি শুধুই পরিচিত? তাদের সঙ্গে মনের সব কথা শেয়ার করার কি কোনো পরিসর নেই? বোধহয় নেই। নাহলে চার হাজার বন্ধু, আর কয়েক শো ফলোয়ার নিয়েও এই নিঃসঙ্গতা কেন?
তেমনই একটা সন্ধ্যে। লকডাউন। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ একটা ফেসবুক পোস্ট। তারপরই ফেসবুক লাইভে ভেসে উঠল চন্দ্রিমার মুখ। ফ্যাকাসে, রুগ্ন। ল্যাম্পের হলদেটে আলোয় চন্দ্রিমার পেছনে সিলিং থেকে কী একটা যেন ঝুলতে দেখা যাচ্ছে।
চন্দ্রিমা টেবিলের ওপর ফোনটা সেট্ করে বিছানায় গিয়ে দাঁড়াল। এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু। সিলিং-এর থেকে এতক্ষণ যেটা ঝুলতে দেখা গেছে সেটা একটা কাপড়ের ফাঁস। একী! এটা কী করছে চন্দ্রিমা!
বিছানায় একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে ফাঁসটা গলায় গলিয়ে নিয়েছে সে। মুহূর্তের দমকা বাতাসে ফোনটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। একটা গোঙানির শব্দ…
চুড়মার হয়ে যাওয়া মোবাইলের স্ক্রিনে শুধু ঝুলন্ত দু’টো পা। নিথর।
বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে একনাগাড়ে ফোনটা বেজে যাচ্ছে আজ। সেই রিংটোন…চন্দ্রবিন্দুর গান…‘বন্ধু তোমায় এ গান শোনাব বিকেল বেলায়…বন্ধু তোমায়…।’
কেউ ধরছে না আর…।