গুরুদক্ষিণা - চিত্তরঞ্জন গিরি
“তোমরা যে কারোর কাছে তিন মাস পড়ে টিউশনির টাকা না দিয়ে আবার অন্য ছেলের কাছে চলে যাও। সেখানেও সেই রকম করো। এতে কার ক্ষতি হয়? স্যারের প্রাথমিক কিছু ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু তারচেয়েও বেশি অনেক ক্ষতি ছাত্র দের।”
গড়িয়া শ্রীনগরে সায়ন স্যারের কোচিং সেন্টার। কোচিং করার ফাঁকে ছাত্রদেরকে এই কথা শোনালো স্যার।
বিএসসি থার্ড ইয়ারের ক্লাস। রজত বলে” আমি বুঝতে পারলাম না স্যার। ছাত্রদের তো লাভ হল। তিন মাসের টাকা দিতে হলো না।
তার সাথে সুর মিলিয়ে অন্যান্য ছাত্ররাও বলে -হ্যাঁ স্যার তাদের তো লাভই হলো।
কথাটা শুনে ঠোঁটের কোণে এক ধরনের হাসি ছড়িয়ে দিয়ে সায়ন স্যার বলে—বাহ্যিক দৃষ্টিতে তোমাদেরই লাভ। এই টাকা মোবাইলে ডাটা ভরতে পারবে। কিন্তু একটা স্যারের পড়ানোর মধ্যে কষ্ট থাকে। ডেডিকেশন থাকে। অনেকটা আশা থাকে। এই টাকা নিয়ে তার সংসার চালাবে। স্ত্রী বাচ্চাদের মুখে হাসি ফোটাবে। তা তোমরা করতে দিলে না। স্যারের পরিশ্রমের দাম দিলেনা। এটা পরিশ্রম শুধু নয় একজন স্যার একটা স্টুডেন্টের ভাবনা চিন্তা ধারা জীবনের দিক পাল্টে দিতে পারে। সেই স্যারের দক্ষিণা যদি তুমি না দাও তোমাদের জীবনে তো প্রভাব পড়বে।
রজতের পাশে বসে ছিল শ্রীমন্ত। কথা শুনে চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ। অন্যান্যদেরকে বলে স্যার শুধু নিজের টাকা তুলে নেওয়ার জন্য কিছু একটা গল্প বানাচ্ছে। স্যারের সাথে চোখাচোখি হতেই
শ্রীমন্ত বলে- কিভাবে স্যার?
স্যার শ্রীমান্তের মুখের ভাব ভঙ্গি টা দেখে মনে মনে ভাবে আমার কথা শ্রীমন্ত বিশ্বাস করতে চায় না। হেও চোখে দেখছে।
যদিও শ্রীমন্ত প্রত্যেক মাসের টাকা ঠিকভাবে দিয়ে এসেছে।
স্যার বলে”গুরুর ঋণ শোধ না করলে। পড়াশোনাতে তার প্রভাব পড়বে। আমার বিশ্বাস। শুধু তাই নয় এই প্রভাব তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে পড়তে পারে।
স্যারের কথা শুনে রজতের পাশে বসা অন্বেষা বলে “তাহলে আমার কি হবে! বাড়ির অবস্থা খারাপ। স্যার কে এই কথা বলেই স্যারকে500 টাকা কম নিতে রাজি করিয়েছি। এটা কি আমার জীবনের উপর প্রভাব পড়বে?
অন্বেষার চোখেমুখে টেনশন! তা দেখে রজত বলে –টেনশন করিস না। তুইতো স্যার কে অনুরোধ করে কাজটা করেছিস। ভগবান তোকে শাস্তি দেবে না।
কথাটা দিবাকরের কানে যায়। সে মিটমিট করে হাসছিল। বলে-স্যার কে ফাঁকি দিয়ে টাকা ঝেড়ে প্রেমিকের সাথে সিনেমা দেখেছিস। পার্কে পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। প্রভাব তো পড়বেই ।
আরো মুখ শুকিয়ে যায় অন্বেষার।
রজত তাকে আশ্বস্ত করে–প্রত্যেক মাসের টাকাটা ঠিকমতো দিয়েছিস তো?
শুকনো মুখে মাথা নাড়ে অন্বেষা। “হ্যাঁ দিয়েছি।”
–তাহলে তোর কিছু হবে না। অত চিন্তা করিস না।
কথাটা শুনে খানিকটা স্বস্তি পেল অন্বেষা।
এই নিয়ে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ফিসফাস গুঞ্জরণ হতে থাকে।
শ্রীমন্ত বলে–স্যার আপনাকে আমার একটা জিজ্ঞাসা ছিল? প্র্যাকটিক্যালি এই রকম প্রভাব পড়তে আপনি কি দেখেছেন?
কথাটা শুনে স্যার বলে”অবশ্যই আমার বাস্তবে দেখা। একটা ছেলে তিন মাসের পয়সা না দিয়ে পালিয়ে গেছিল। অন্য জায়গায় টিউশান নিয়েছিল। রেজাল্টের সময় তাকে ফেল করতে দেখেছি। এটা শুধু টাকা-পয়সার ক্ষেত্রেও নয় যারা আমার কাছ থেকে বই নিয়ে গিয়ে বলেছে দু-একদিনের মধ্যে দিয়ে দেবে। কিন্তু আর দিল না তাদের ওপরও প্রভাব পড়েছে বা না পড়ে থাকলে ভবিষ্যতে পড়বে। আমি কিন্তু আগাম তোমাদের সতর্ক করে দিলাম। কেউ কেউ ভাবতে পারো যাতে ছাত্ররা ভয়ে ঠিক মত টাকা দিয়ে দেয় তার জন্য সব ভয় দেখাচ্ছেন। আমার বলার কর্তব্য আমি বলে দিলাম। কর্ম তোমাদের ফলও ঘটবে ঠিক সেই কর্ম অনুযায়ী।
টিউশান ছুটির পরে বাড়ি ফেরার পথে। অন্বেষা কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় শ্রীমন্ত। পরীক্ষাকে দু মাস বাকি। আমি স্যারের ফিসটা দেবো না। দেখি আমি ফেল করি কিনা।
অন্বেষা বলে ওসব করিস না। পরীক্ষা নিয়ে ছেলে খেলা করিস না। এটা জীবনের ব্যাপার।
–রাখত তোর জীবন। স্যার একটা গুলতানি মেরে দিল। আমাকে তা মেনে নিতে হবে ?
দিবাকর বলে –ঠিক বলেছিস। ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার দুটোতে তোর ফার্স্ট ক্লাস! তুই এটা এক্সপেরিমেন্ট করতে পারিস। কত আর খারাপ হবে। বড়জোর ফাস্ট ক্লাস থেকে সেকেন্ড ক্লাস হবে। এরবেশি তো নয়।
সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপে উঠে শ্রীমন্ত। কেন খারাপ হবে। ভালো প্রিপারেশন থাকলে ভালো রেজাল্ট হতে বাধ্য। স্যারের গুলতানি কথা আমি বিশ্বাস করিনা।
রজত তাকে বাধা দেয়। —এমন কাজ করিস না। কোথায় কি হবে পরে আফসোস করবি!
–তুই যেরকম ভীরু! আমি তা নই। আমি তোদের সামনে করে দেখাবো।
রজত কিছু বলল না।
দু মাস কেটে যায়। পরীক্ষা হয়ে যায়। সীমান্তের পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। একগাল হেসে বলে আমি তো দু মাসের টাকা দিইনি। দেবো না। স্যারের কাছে তো আর পড়তে যাব না। দেখি আমার রেজাল্ট কে আটকায় ?
কয়েক মাস পর রেজাল্ট বেরোলো। একে একে রেজাল্ট নিয়ে স্যারের সাথে দেখা করে। প্রত্যেকেই ভালো রেজাল্ট করেছে।তার ব্যাচের সবচেয়ে ভালো ছেলে শ্রীমান্তের কোন খবর নেই! যাকে জিজ্ঞেস করে কেউ উত্তর দিতে পারছেনা। অবশেষে ফোন। না সুইচ অফ! কি হলো শ্রীমন্তের চিন্তায় আছে স্যার। তার কাছে তো বেশি এক্সপেক্টেশন!
দশ পনেরো দিন কেটে যায় । হঠাৎ একা হাজির হয় শ্রীমন্ত। স্যারের পা ধরে বলে””স্যার আমি এত ভালো পরীক্ষা দিলাম। আমার রেজাল্ট এসেছে ফেল! মনে হয় আমার দম্ভের জন্য এই ঘটনা ঘটেছে। আপনার কথা যদি আমি আগে শুনতাম। আপনার তিন মাসের টাকা বাকি ছিল। পকেট থেকে টাকা বের করে ধরিয়ে দেয়।
স্যার বলেন দুই মাসের টাকা দেবে তিন মাসের কেন ?
কাচুমাচু হয়ে শ্রীমন্ত বলে আপনি হয়তো জানেন না। আগে আরো একমাস বাকি ছিল। স্যার অবাক চোখে তাকায়।
— আপনার কথা যে এত বড় সত্যি হয়ে দাঁড়াবে আমি ভাবতে পারিনি! আমায় ক্ষমা করে দেবেন স্যার!
চিত্তরঞ্জন গিরি

Tags: The Indian Rover