
বাংলা আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথ উৎসব হয়ে থাকে। এই দিন দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে গুন্ডিচা মন্দিরে যান জগন্নাথদেব। সেখান থেকে সাতদিন পর নিজ মন্দিরে ফিরে আসেন। যাওয়ার দিনকে বলে সোজা রথ এবং একই পথে নিজ মন্দিরে ফিরে আসাকে বলে উল্টোরথ । গুন্ডিচা মন্দির ভ্রমণকেই আবার মাসির বাড়ি যাওয়া মনে করেন অনেকে। রথযাত্রার কথা বললে প্রথমেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে শ্রীক্ষেত্র পুরীর ঐতিহ্যপূর্ণ রথযাত্রার ছবি। ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে রথোৎসব পালিত হলেও পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রাই হলো প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম। রথযাত্রার দিনটিকে বাঙালিরা একটি পুণ্যতিথি বলে মনে করে। এই দিন নানারকম শুভকার্য্যের সূচনা হয়। যেমন গৃহনির্মাণ, গ্রন্থরচনা, যাত্রা ইত্যাদি। রথের দড়ি টানাকেও পুণ্যের কাজ হিসাবে গণ্য করেন ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা।

◆ রথযাত্রার রীতিনীতি:
স্নানযাত্রার দিন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে প্রচুর পরিমাণে দুধ ও গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করানো হয়। বিশ্বাস করা হয়, এই স্নানের ফলে জ্বর ভোগ করেন দেবতারা। ধীরে ধীরে তাঁদের জ্বর কমে এবং সুস্থ হয়ে ওঠেন। স্নানযাত্রার কয়েক দিন পরে হয় ‘অঙ্গরাগ’ উৎসব। যখন বিগ্রহগুলির রং করা হয়। এর পর ‘নবযৌবন উৎসব’। রথযাত্রার একদিন আগে রাজা হিসেবে অভিষেক হয় প্রভু জগন্নাথের। সাধারণ দিনগুলিতে ভক্তদের বিগ্রহ স্পর্শ করতে দেওয়া হয় না। কিন্তু, রথ এবং উল্টো রথের দিন সকলেই বিগ্রহ স্পর্শ করতে পারেন। মালা পরিয়ে প্রার্থনা জানাতে পারেন।
◆◆◆ জগন্নাথধাম শ্রীক্ষেত্র পুরীর রথযাত্রার ইতিহাস:
হিন্দু মতে,পুরী চার ধামের অন্যতম। আবার শ্রী ক্ষেত্র নামেও পরিচিত। প্রায় আনুমানিক সাতশো বছরের পুরনো পুরীর রথযাত্রা উৎসব। জগন্নাথধাম শ্রীক্ষেত্র পুরী ঘিরে একাধিক রহস্যময় কাহিনি প্রচলিত রয়েছে । মূলত পুরীর মন্দির ঘিরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রহস্যময় কাহিনিও উঠে এসেছে। ওড়িশার প্রাচীন পুঁথি ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ অনুযায়ী সত্যযুগ থেকে চালু হয়েছে এই রথযাত্রা। সেই সময় ওড়িশার নাম ছিল মালবদেশ। সেই সময় মালবদেশের সূর্যবংশীয় পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ম স্বপ্ন পেয়েছিলেন বিষ্ণু মন্দির গড়ার। মন্দির কেমন হবে সেসম্পর্কে রাজার তেমন ধারণা ছিল না। মন্দির স্থাপন করে জগন্নাথ , বলরাম, সুভদ্রার মূর্তি তৈরি ঘিরে বিশ্বকর্মাকে অসন্তুষ্ট করে ফেলেন ইন্দ্রদ্যুন্ম। যার জেরে দেবদেবীদের সম্পূর্ণ মূর্তি নির্মাণ না করেই চলে যেতে হয় বিশ্বকর্মাকে। এদিকে, কথিত রয়েছে, যে শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে রথে চড়ে দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে দেখতে যান জগন্নাথদেব। সেই উপলক্ষ্যে ওই তিথি মেনে গুন্ডিচা মন্দিরে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার আয়োজন হয়। এই যাত্রাকে সোজা রথ যাত্রা বলা হয়। এরপর সাত দিন পর মন্দির থেকে দেবতার ফিরতি যাত্রাকে উল্টোরথ যাত্রা বলা হয়। যদিও মাসির বাড়ি যাওয়া নিয়ে রথ যাত্রার আরও এতটি পৌরাণিক কাহিনিও শোনা যায়। রাজা ইন্দ্রদ্যুন্মর হাত ধরেই পুরীতে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন শুরু হয়। পুরাবিদেরা বলেন, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রীই ছিলেন গুণ্ডিচা। তবে এ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিভেদ দেখা যায়।

■■ পুরীতে ৬ টি রথের ইতিহাস:
আগে পুরীতে ৬ টি রথ ব্যবহার করা হত। জগন্নাথদেবের পুরীর মন্দির থেকে তাঁর মাসির বাড়ি গুন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত যাওয়ার পথকেই বড় দান্ডে বলে। বড় দান্ডে তে একটি নদী ছিল। নদীর দক্ষিণ পাড়ে ছিল অর্দ্ধাশনী (প্রাচীনকালে যখন মহাপ্রলয় হয় তখন অর্ধেক জল পান করেছিলেন বলে নাম হয় অর্দ্ধাশনী শক্তি। অর্দ্ধাশনী শক্তির দর্শনে বিশেষ পুণ্য লাভ হয় তাই এর নাম অর্দ্ধাশনী শক্তি।) আর গুন্ডিচা ছিল উত্তর পাড়ে। এই নদী পারাপার করার জন্য তখন কোন ব্রিজ ছিল না তাই তিনটি রথে জগন্নাথ দেব, বলরাম এবং সুভদ্রাকে নদীর দক্ষিণ পাড়ে আনা হত এবং তারপর তাঁদেরকে নদী পার করিয়ে উত্তর পাড়ে রাখা আরো তিনটি রথে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হত গুণ্ডিচা মন্দির মাসির বাড়িতে। পুরীর মন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দির যেতে যে রাস্তা ব্যবহার করা হতো সেই রাস্তায় বলাগুন্ডি নামের একটি চওড়া নালা পড়তো। আসলে এটি ছিল সারদা নদী। ১২৮২ সালে রাজা কেশরী নরসিংহ পুরীর রাজ্য ভার গ্রহণ করেন। তিনি রাজ্য ভার গ্রহণ করার পরেই এই বলাগুণ্ডি বুজিয়ে দেন সুতরাং এপার ওপার যাওয়ার জন্য কোন অসুবিধা আর থাকে না। তখন থেকে রথযাত্রা সম্পন্ন করার জন্য তিনটি রথই যথেষ্ট হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনটি রথেই রথযাত্রা সম্পন্ন হয়।
■■ পুরীতে রথ উৎসব:
পুরীতে প্রতি বছর রথযাত্রার উদ্বোধন করেন সেখানকার রাজা। রাজত্ব না থাকলেও বংশপরম্পরা ক্রমে পুরীর রাজপরিবার আজও আছে। সেই রাজপরিবারের নিয়ম অনুসারে, যিনি রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন, তিনিই পুরীর রাজা জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর পর পর তিনটি রথের সামনে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করেন এবং সোনার ঝাড়ু ও সুগন্ধী জল দিয়ে রথের সম্মুখভাগ ঝাঁট দেন। তারপরই পুরীর রথের রশিতে টান পড়ে। শুরু হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। তিনজনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রথ। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় দিকটিও হল এই রথ তিনটি। তিনটি রথ যাত্রার কিছু নিয়ম রয়েছে এবং রথের আকার, রঙেও ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন-
- প্রথমে যাত্রা শুরু করে বড় ভাই বলভদ্রের রথ। এই রথের নাম তালধ্বজ। রথটির চৌদ্দটি চাকা। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের আবরণের রঙ নীল।
- তারপর যাত্রা করে বোন সুভদ্রার রথ। রথের নাম দর্পদলন। উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এই রথের মোট বারোটি চাকা। যেহেতু রথটির ধ্বজা বা পতাকায় পদ্মচিহ্ন আঁকা রয়েছে, তাই রথটিকে পদ্মধ্বজও বলা হয়ে থাকে। রথের আবরণের রঙ লাল।
- সর্বশেষে থাকে শ্রী কৃষ্ণ বা জগন্নাথদেবের রথ। রথটির নাম নন্দীঘোষ। পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি আঁকা রয়েছে তাই এই রথের আর একটি নাম কপিধ্বজ। রথটির উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। এতে ষোলোটি চাকা আছে। রথটির আবরণের রঙ হলুদ।
তিনটি রথের আবরণীর রঙ আলাদা হলেও প্রতিটি রথের উপরিভাগটি লাল রঙেরই হয়ে থাকে। রথ তিনটি সমুদ্রোপকূলবর্তী জগন্নাথ মন্দির থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে গুণ্ডিচা মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। সেখানে সাতদিন থাকার পর আবার উল্টো রথে জগন্নাথ মন্দিরে ফিরে আসে।

■■ পুরী জগন্নাথ মন্দির:
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চার ধামের একটি জগন্নাথদেবের মন্দির। বিশেষ করে বিষ্ণু ও কৃষ্ণ উপাসকদের নিকট এটি পবিত্র তীর্থস্থান। জগন্নাথ মন্দিরটি পুরীর পূর্ব সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত। ১০.৭ একর জমিতে ২০ ফুট প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত জগন্নাথ মন্দির। ভোগমন্দির, নটমন্দির, জগমোহনা এবং দেউল নামে চারটি বিশেষ কক্ষ আছে মন্দিরে। ভোগমন্দিরে খাওয়া দাওয়া হয়, নটমন্দিরে আছে নাচগানের ব্যবস্থ্যা, জগমোহনায় ভক্তরা পূজাপাঠ করেন এবং দেউলে পূজনীয় বিগ্রহগুলো স্থাপিত। প্রধান মন্দিরের কাঠামো মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে নির্মিত এবং দুটি আয়তাকার দেয়াল দ্বারা আবৃত। বহিঃপ্রাঙ্গণকে মেঘনাদ প্রাচীর বলা হয় এবং অভ্যন্তরীণ ঘাঁটিটি কুর্মাবেদ নামে পরিচিত । মন্দিরে চারটি প্রবেশদ্বার রয়েছে– সিংহদ্বার, হষ্বদ্বার, খঞ্জদ্বার এবং হস্তীদ্বার। জগন্নাথ মন্দিরের আশেপাশে প্রায় তিরিশটি ছোট-বড় মন্দির লক্ষ্য করা যায়। মন্দিরের দেউলে রয়েছে জগন্নাথ, জগন্নাথের দাদা বলরাম এবং বোন সুভদ্রাদেবীর সুসজ্জিত মূর্তি। তাদের বিগ্রহের পাশাপাশি সুদর্শন, শ্রীদেবী, ভূদেবী এবং মাধব দেবতাও ভক্তদের দ্বারা আরাধিত। এখানে প্রতিদিন কিশোর ছেলেরা কিছু নির্দিষ্ট পূজাবিধি অনুসরণ করে মন্দিরের ৬৫ মিটার (২১০ ফুট) উঁচুতে উঠে চক্রের উপর পতাকাগুলো লাগায়। গ্রীষ্ম, বর্ষা সবসময়ই তারা প্রস্তুত পতাকা স্থাপনে। আগের দিনের পুরনো পতাকাগুলো জনগণের মাঝে নিলামে বিক্রয় করা হয়। জগন্নাথ মন্দিরের রান্নাঘরকেও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রান্নাঘর মনে করা হয়। এখানে প্রায় ছাপান্নরকম উপকরণ দিয়ে মহাপ্রসাদ তৈরি করা হয়। প্রত্যেকদিন এখানে প্রচুর পরিমাণ রান্না করা হয়, কিন্তু দেখা গেছে আজ পর্যন্ত মন্দিরের খাবার কখনোই নষ্ট হয়নি।
■■ জগন্নাথ মন্দিরের অস্বাভাবিকতা এবং লোকবিশ্বাস:
- জগন্নাথ মন্দিরের ওপরের অংশটিতে রত্নমূর নামের একটি বৃহৎ অদ্ভুত চৌম্বক শক্তি রয়েছে, যেটি মন্দিরটিকে যে কোনোরকমের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে বলে মনে করা হয়।
- কথিত আছে, মন্দিরের উপর দিয়ে কিছু যেতে পারে না। কোনো পাখিকেও কখনো মন্দিরের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখা যায়নি।
- এমনটা শোনা যায় যে, সূর্যের অবস্থান যে দিকেই থাকুক, মাটিতে মন্দিরের চূড়ার কোনো ছায়া পরিলক্ষিত হয় না।
- পুরীর সমুদ্রের কাছেই স্থাপিত জগন্নাথ মন্দির। কিন্তু মন্দির চত্বরে ঢোকার সাথে সাথেই সমুদ্রের কোনো শব্দ পাওয়া যায় না। এর কারণ হিসেবে ব্রহ্মরা বলে থাকেন, সুভদ্রাদেবী চেয়েছিলেন মন্দিরের ভেতরে যেন সবসময় শান্তি বিরাজ করে, তাই কোনো প্রকার শব্দ মন্দিরের শান্তি বিঘ্নিত করতে পারে না।
- মন্দিরের চূড়ায় যে ধ্বজা বা পতাকা রয়েছে, তা প্রতিদিন লাগানো হয়। পতাকাটি সবসময় হাওয়ার বিপরীতে উড়তে দেখা যায়।

এরকম প্রচুর লোককথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই জগন্নাথ দেবের মন্দিরকে ঘিরে।
তথ্যসূত্র:
■ পৌরাণিক জনশ্রুতির কাহিনীসূত্র: অন্তর্জাল মাধ্যম ।

লেখক পরিচিতি: –
নদীয়া জেলার শান্তিপুরে বেড়ে ওঠা, শিক্ষাজীবন কলকাতাতে এবং কর্মসূত্রে হুগলীর জেলার চন্দননগরের বাসিন্দা শ্রী শুভজিৎ তোকদার শিক্ষাগত যোগ্যতায় জীববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পেশায় সমবায় ব্যাংকের শাখা প্রবন্ধক। কিন্তু নেশায় ভবঘুরে। ভ্রমণই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান । ডেবিট ক্রেডিটের জীবন থেকে সপ্তাহশেষে দু একদিন ছুটি মিললেই রেলগাড়ির কু ঝিকঝিক ডাকে সাড়া দিয়ে পগার পাড়। সপ্তাহ শেষে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা হাওড়া স্টেশন আবার সপ্তাহের প্রথমদিন ট্রেন থেকে নেমেই অফিস – এই হলো ভ্রমণপাগল মানুষটির মূলমন্ত্র। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, জলপ্রপাত কিম্বা স্থাপত্য সবই সমান ভাবে আকর্ষন করে। গলায় একটা ক্যামেরা আর পিঠে ব্যাগ নিয়ে সপ্তাহান্তের নতুন নতুন ঠিকানা খুঁজে নেওয়া – এইভাবে ভ্রমণবন্ধুর জীবন ।
প্রথমে লেখালেখি শুরু সামাজিক মাধ্যমে, সেখান থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, পুজোসংখ্যা, ই–ম্যাগাজিন, সংবাদপত্রে ভ্রমণকথা লেখার শুরু। “ভ্রমণপিপাসু“, “ভ্রমণ“, “উত্তরবঙ্গ সংবাদ“, “সাতফোড়ন“, “দর্পন” বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে একাধিক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, ভ্রমণকথা, ভ্রমণ গাইড যেটা থেকে বিভিন্ন মানুষ উপকৃত হয়েছেন বাড়েবাড়ে । ২০২২ সালে কলকাতা বইমেলায় ভ্রমণপিপাসু প্রকাশনীর দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে লেখকের প্রথম বই “ভবঘুরের ভ্রমণকথা“ যা পাঠকমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত ।