আশাপূর্ণা - অন্তরা চন্দ্র
ছয় বছরের ছোট্ট মেয়েটা নতুন জামা গায়ে দিয়ে অষ্টমীর সকালে মন্ডপে অঞ্জলী দিতে আসে। পূজোয় তার প্রতি বছর এই একটা করেই নতুন জামা হয়। বাবা পছন্দ করে কিনে এনে দেয়। অষ্টমীর দিন ভাঁজ ভেঙে পরপর তিন দিন ওই জামাটা পরেই সে মন্ডপে যায় এবং সেখানেই তার সারাদিন কাটে। বাড়িতে মা নিজের হাতে মাটির গয়না তৈরী করে, খুব যত্ন নিয়ে কয়েক মাস ধরে গয়না গুলোতে রং চাপায়, আর মেয়েটা সেগুলো সারাটা পূজো জুড়ে মন্ডপের সামনে বিক্রী করে।
আজ দশমী। পূজো টা আনন্দে কেটেছে। অনেক ভালো ভালো দিদিরা সব ঠাকুর দেখতে এসেছিল। তারা বেশ কিছু গয়না কিনেছে। মা খুব খুশি, বলেছে লক্ষী পূজোর দিন এবার লুচি করবে। তার উপর সে গত দুদিন থেকে শুনছে যে এই বছর বিজয়া তে ওদের প্যান্ডেল প্রাইজ পাবে। ছোট শহরের পূজো গুলির মধ্যে তাদের প্যান্ডেল অন্যতম সেরা হয়েছে। এত সব খবর পেয়ে মেয়ে আহ্লাদে আটখানা।
একদল দাদা দিদি এসে মন্ডপের বাইরে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছিল। আজ গয়না বেচতে তেমন মন নেই। তবু মায়ের কথা ভেবে সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। মায়ের শেখানো লাইনটা ও সবাইকেই বলে।
- দিদি তোমরা মাটির গয়না নেবে? তোমাদের এই শাড়ি আর কুর্তির সাথে খুব মানাবে।
গয়না গুলো তে চোখ বুলিয়ে একজন বলল, “কত করে এগুলো?”
- এই কানের দুল তিরিশ টাকা করে। আর গলার হারের সাথে নিলে পুরো সেট পঞ্চাশ টাকা পড়বে।
তারা কয়েকটি গয়না হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে নিজেদের মধ্যে কথা বলে, “জাস্ট দেখ, মলে গেলেই এগুলোর পাঁচ ডবল দাম। মেটিরিয়াল টাও এমন অরগ্যানিক নয়। অথচ এগুলো কত বেশী ইউনিক অ্যান্ড অরিজিনাল।”
অন্য একটা দিদি বলল, “আমায় ওই হলুদ পাখি আঁকা টা একবার দেখা।”
- এই নাও। এটা কেনো দিদি। আমার মায়ের বানানো সব। তোমার এই শাড়ি টা খুব সুন্দর। এর সাথে তোমায় দারুন লাগবে।
- তাই বুঝি? তোর জামাটাও তো খুব সুন্দর। কে কিনে দিয়েছে?
- বাবা এনেছে। এটা আমার নতুন জামা।
“বাহ। খুব ভালো। কি নাম তোমার?”, অন্য একজন প্রশ্ন করে।
- (লজ্জা পেয়ে) আমার নাম আশা।
- খুব সুন্দর নাম।
কথার আদরে উচ্ছসিত হয়ে ওঠে আশা।
- জান, আজ সন্ধ্যাবেলা আমাদের প্যান্ডেলকে প্রাইজ দেবে। আমার বাবাও প্রাইজ পাবে।
- তাই? তোমার বাবাও পাবেন?
- হ্যাঁ গো। যারা সব থেকে সুন্দর প্যান্ডেল করেছে তাদেরকে দেবে। এই প্যান্ডেলটা তো আমার বাবা তৈরী করেছে। এই বাঁশ কাপড় সব নিজের হাতে বেঁধেছে। প্রতি বছর করে। আমি পূজোর আগে দেখতে আসি বাবার কাজ।
- ওহ্ . . . আচ্ছা বেশ . . . সে নাহয় সন্ধ্যাবেলা হবে। এখন বরং তুই আমাদের সাথে একটা আইসক্রিম খা।
ওরা আশাকে আইসক্রিম কিনে দেয়। সে খেতে খেতে ভাবে মা কে বলতে হবে আজ দুধ আইসক্রিম খেয়েছে।
সন্ধ্যা নেমে আসে। আশার আর তর সইছে না। বাবা কি প্রাইজ পাবে কে জানে। রাত আটটার পরে বাইরে থাকা নিষেধ। সে বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে আবদার করে। বাবার প্রাইজের আনন্দে পাড়ার কাকুর দোকান থেকে কাল একটা ছোট প্যাকেটের বিরিয়ানি কিনে খাবে। মা বাবা কেও তার থেকে একটু করে ভাগ দেবে। মা বলে সে হবে ক্ষণ। আশা অধীর অপেক্ষায় বসে থাকে।
রাত দশটা নাগাদ বাবা বাড়ি ঢোকে। আশা ছুটে যায়।
- প্রাইজ পেয়েছ তোমরা?
- হ্যাঁ মা, আমরা দ্বিতীয় হয়েছি। আমাদের পূজো এবছর খুব ভালো হয়েছে।
- কই দেখি কি প্রাইজ পেলে?
আশাকে কোলে তুলে নিয়ে বাবা হাসি হাসি মুখে তার হাতে বিরিয়ানির একটা বড় প্যাকেট দেয়।
- আমায় এটা দিয়েছে। এইটা আমাদের প্রাইজ!
- এটা তো খাবার জন্য কিনে দিয়েছে। আজ যেমন ভালো দাদা দিদিরা আমায় আইসক্রিম কিনে দিয়েছিল। তুমি যে এত সুন্দর করে কাজ করলে, তার জন্য তোমায় কোনো আসল প্রাইজ দেয়নি বাবা?
মেয়ের ছলো ছলো চোখের দিকে তাকিয়ে বাবা হেসে ওঠে, “আমার আসল প্রাইজ তো তুই রে মা! তুই আমার মা দুর্গা! আমি যে প্যান্ডেল তৈরী করি, তার ভিতরে তো আমি তোকেই দেখতে পাই।”
বাবার কথা শুনে আশার চোখের জল মিলিয়ে যায়। মা দুর্গা হলে তো তার কাঁদা চলে না। তাকে আরো শক্তিশালী হতে হবে। সিংহের পিঠে চড়ে হাতে অস্ত্র নিয়ে অসুর বধ করতে হবে যে . . . !