ফ্যান্সি লেনের অন্দরে - সায়ন তালুকদার
“কলকাতা,তুমিও হেঁটে দেখ কলকাতা…”।হ্যাঁ, সত্যিই ইতিহাসের রঙে ছোপানো এই কালের শহর, ভালোবাসার শহর কল্লোলিনী কলকাতাকে যদি আপনাকে গভীরভাবে চিনতে,জানতে,বুঝতে হয় তাহলে আপনার এগারো নম্বরই একমাত্র সলিউশন।
চলুন পায়ে পায়ে হেঁটেই তিলোত্তমার বুকে ইতিহাসের গন্ধ খোঁজা শুরু করি।আজ যাওয়া যাক ‘ফ্যান্সি লেন’।
ঐতিহাসিকদের মতে,এই ‘ফ্যান্সি’ শব্দের সঙ্গে শখ বা শৌখিনতার কোনো সম্পর্ক নেই।বাংলায় এই রাস্তাকে বলা হত ফাঁসি লেন।না,আপনি শুনতে কোনো ভুল করেননি।ইংরেজরা ‘ফাঁসি’ উচ্চারণ করতে পারতেন না বলে ‘ফ্যান্সি’ বলতেন। সেই থেকেই এই রাস্তার নাম ‘ফ্যান্সি লেন’। ডালহৌসির কাছে এখন যেখানে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট,সাহেবি আমলে লালদিঘির প্রায় গা-ঘেঁষে ছিল সাহেবপাড়া, তার খুব কাছেই এই ফ্যান্সি লেন।একটা সময় এর পাশ দিয়ে একটা খাল বা ‘ক্রিক’ প্রবাহিত হত বলে জানা যায়। এখন অবশ্য সেটি আর নেই।
আর্চডিকন হাইড তাঁর ‘প্যারোকিয়াল অ্যানালস’ এবং ‘পেরিশ অব বেঙ্গল’ বই দুটিতে বলেছেন-“The creek took a half turn round this battery and kept Eastwards beneath three gated bridges, until the fences turned downwards from it at Fancy Lane.
”নবাবি ইতিহাস বলছে, একসময় এই পুরো জায়গাটাই ছিল জঙ্গলে ভরা।
লোকজন বিশেষ ছিল না বললেই চলে।
থাকার মধ্যে ছিল অজস্র গাছ, বেশ কিছু চোর-ডাকাত, মাঝে মাঝে নবাবের সেপাই-সান্ত্রী আর কিছু তীর্থযাত্রী, যারা প্রাণ হাতে নিয়ে পার হত ওই এলাকা।তখনও পলাশির যুদ্ধ হয়নি, ফলে গোরা সাহেবের রাজত্বও শুরু হয়নি এ দেশে।
সেইসময় হালিশহর থেকে কালীঘাটের মন্দির পর্যন্ত বিরাট লম্বা একটা রাস্তা ছিল। সেটাই ছিল ওই তীর্থযাত্রীদের পথ। কালীভক্তদের দল ওই পথ দিয়েই মন্দিরে যাতায়াত করতেন। রাস্তাটা চৌরঙ্গির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আদিগঙ্গার পাশ ছুঁয়ে কালীঘাটে গিয়ে পড়ত। তীর্থযাত্রী ছাড়াও অনেক ছোটখাটো ব্যবসায়ীর দলও ওই পথ দিয়ে ব্যবসা করতে যেত, সঙ্গে থাকত নানা জিনিসপত্র।চৌরঙ্গির ওই জঙ্গল ছিল চোর-ডাকাতদের আস্তানা। সুযোগ পেলেই তারা তীর্থযাত্রী বা ব্যবসায়ীদের মেরেধরে সবকিছু কেড়ে নিত। বাধা দিতে গেলে প্রাণ যাওয়াটাও বিচিত্র ছিল না। প্রচুর ডাকাতি হত বলে নবাবি কোতোয়ালি বা সেপাইদের চৌকি ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডাকাতি বন্ধ করা যায়নি। তখন নবাবি সেপাইরা ডাকাতদের মনে ভয় ধরানোর জন্য একটা বিচিত্র রাস্তা নিল। মাঝে মাঝে হাতেনাতে ডাকাত ধরে ফেলতে পারলে, দ্রুত বিচার করে ওখানেই ফাঁসি! সরাসরি ওই রাস্তার উপরেই গলায় দড়ি বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া, ব্যস! কারও কারও মতে, সেখানে একটা ফাঁসির মঞ্চ ছিল। আর্চডিকন হাইড তার বইতে দেখিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চটি ছিল একটি গাছের সঙ্গে সংলগ্ন। ১৮০০ সালের কথা। ব্রজকিশোর নামে এক কিশোর পঁচিশ টাকা দামের একটা ঘড়ি চুরি করেছিল।সেই অপরাধে প্রকাশ্য রাস্তায় তৈরি হল সেই ফাঁসির মঞ্চ। জনসাধারণ ভিড় করে দেখেছিল সেই ফাঁসি।সিরাজদ্দৌলার কলকাতা আক্রমণের সময়েও নাকি ‘ফ্যান্সি লেন’ ছিল। ওই রাস্তার কাছাকাছি নবাবের কামান বসানো হয়েছিল ইংরেজদের দুর্গ ফোর্ট উইলিয়াম ধ্বংস করবার জন্য।
কত শত মানুষের ফাঁসির ইতিহাস, তাদের মৃত্যুর সাক্ষী আজও বহন করে চলেছে এই ফ্যান্সি লেন,বর্তমানে যার নাম পান্নালাল ব্যানার্জী রোড।