ইসলামিক আক্রমণ এবং লুটপাটের ইতিহাস - জয়দীপ গোস্বামী
ভারতীয় ইতিহাস তার প্রতিটি পৃষ্ঠাতে ফুটিয়ে তুলেছে রোমাঞ্চ, বিস্ময়, নৃশংসতা এবং বর্বরতা। এই প্রতিটি পৃষ্ঠা আমাদের মানবপটে প্রতি কোনো না কোনো বিস্ময়কর চিত্র ফুটিয়ে তুলছে। যার এক একটা কাহিনি এত মর্মান্তিক যে তা এক সম্রদায়ের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তেমনই এক ঘটনা হলো মুসলিম কর্তৃক হিন্দু মন্দির লুন্ঠন।
ভারত নানা সময়ে নানা বৈদেশিক হানাদার দের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। যার ফলে ভারতের প্রচুর সম্পদ ভারত থেকে লুন্ঠিত সামগ্রী রূপে অন্য স্থানে স্থানান্তর হয়ে গেছল। এই লুঠতরাজ পর্বের সূচনা হয় মুসলিম হানাদার দের ভারতে হানা দেওয়ার পর থেকে। যার ফলে বিপুল পরিমাণে ভারতীয় ধনসম্পদ আরব, পারস্য, ইরাক, গজনির মতো মুসলিম প্রধান অঞ্চল গুলিতে স্থানান্তরিত হয়। বিগত ১ম খ্রীস্টাব্দ থেকে ১০০০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের অর্থনীতি বাকি দেশ গুলোর থেকে অনেক উন্নত ছিলো। এই মুসলিম আগ্রাসনের পর থেকে ভারত তার গৌরব হারায়।
ভারতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাক্তির আগমন ঘটেছিলো। যাদের কারো উদ্দেশ্য ছিলো শিক্ষা, আবার কারোর রাষ্ট্রদূত হিসেবে ভারত ভ্রমণ। তারা এই ভ্রমণ সম্পর্কে প্রতিবেদন রচনা করেন। ভারতে প্রায় বহির্বিশ্বের সব স্থান থেকেই পর্যটন, পরিভ্রমণ করতে আসেন। তারা তাদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে ভারতের রূপমহিমা বর্ণনা করেছেন। তারা উল্লেখ করেছেন যে ভারতের মাটিতে সোনা আর জলে রূপোর চাষ হয়, অর্থাৎ ভারত চিরকালই শস্যশ্যামলা দ্বারা পরিবৃত। এই সব বিবরণ এর পর থেকে বহির্বিশ্বের কাছে ভারত সম্পর্কে কৌতুহল বাড়তে থাকে, যার ফল স্বরূপ হানাদার রা ভারতের বুকে পা রাখে। এই পর্বের সূচনা হয় মুসলিম দের ভারত আগমনের পর থেকে। ভারতে প্রথম মুসলিম আগমন ঘটে ৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে মহম্মদ বিন কাশিম এর নেতৃত্বে। এই সময় মুসলিম বাহিনী সিন্ধ অঞ্চলে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। এই সময় তারা বেশ কিছু ধনসম্পদ লুঠ করে। এর পর আফগানিস্তানের পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে ক্রমাগত মুসলিম দের আগমন ঘটতে থাকে।
সব থেকে নৃশংস লুঠতরাজ হয়েছিল মুসলিম দের দ্বারা। চিরাচরিত হিন্দু রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম আগ্রাসন। প্রথম দিকে এই মুসলিম রা স্বাধীন ভাবে বসবাস করার জন্য ভারতে আসেনি। তারা কেবল ধনভাণ্ডার লুঠ করার জন্য ভারতে আসত। এই আগ্রাসনের তীব্রতার ফলে ভারতীয় ঐতিহ্য লুন্ঠিত হয়েছিল।
এই রকমই একজন হানাদার হলেন গজনির সুলতান মামুদ। ১০০০ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১০২৭ খ্রীঃ এর মধ্যে ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন। তার এই আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো ভারতের সম্পদ লুঠ করা স্থায়ী ভাবে বাস করা না। তিনি উত্তর ভারতের অনেক জায়গা তে হানা দেন। তিনি ভারত থেকে প্রচুর সম্পদ লুঠ করে নিজের দেশে নিয়ে যান। তাঁর এই নৃশংসতার একটু ধারণা দেওয়া যাক—
তুর্কিস্তান এর অন্যতম প্রধান জনপদ হলো এই গজনি। এই গজনি তে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজা শাসন করেছেন। উল্লেখযোগ্য সুলতান হলেন আলপ্তগিন, এবং এই আলপ্তগীনের মৃত্যুর পর ৯৭৭ সালে গজনির সিংহাসনে বসেন সবুক্তগীন।
৯৯৮ সালে গজনির সিংহাসনে মামুদ আরোহন করেন। তিনি গজনিকে তার সাম্রাজ্যের রাজধানী করেছিলেন। মামুদ ২৭ বছর বয়সে সুলতান উপাধি গ্রহন করেন। এরই পর থেকে সুলতান উপাধি গ্রহনের ধারা শুরু হয়।
মামুদের এই ভারতে হানা দেওয়ার নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদ দের মতে —
ভারতের বিপুল ধনসম্পদ লুঠ করাই ছিল তার এক মাত্র উদ্দেশ্য।
তিনি ইসলাম ধর্মের সম্প্রসারণ এর উদ্দেশ্যে ভারতের মাটিতে পা দিয়েছিলেন।
পশ্চিম ভারতের শক্তিশালী রাজপুতদের মধ্যে ঐক্যের অভাব দেখা দিয়েছিল। তারা পরস্পর বিবাদে নিমজ্জ থাকত এই সুযোগে গজনি ভারতে প্রবেশ করেন ।
ভারতে মামুদের কর্মকাণ্ডের একটা তালিকা দেওয়া যাক—
মামুদ ১০০০ খ্রীঃ থেকে ১০২৭ খ্রীঃ পর্যন্ত ১৭ বার ভারত আক্রমণ করে।
১০০০ খ্রীঃ প্রথম বার আক্রমণ করে বর্তমানে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান অঞ্চলে।
১০০৫ খ্রীঃ হানা দেয় ভাটিয়া অঞ্চলে।
১০০৬ খ্রীঃ মুলতানে আক্রমণ করেন।
১০০৭ সালে ভাতিন্ডাতে হানা দেন।
১০১১ সালে পাঞ্জাব পার্বত্য অঞ্চলে লুঠপাট চালান।
১০১৩ সালে পাকিস্তান এবং পূর্ব আফগানিস্তানের বেশ কিছু অঞ্চলে।
১০১৪ খ্রীস্টাব্দে থানেশ্বর শিব মন্দিরে লুঠ করে প্রায় ধংস করেন।
১০১৫ সালে কাশ্মিরে আক্রমণ করেন।
১০১৮ সালে মথুরা লুঠ করেন। এই সময় মথুরা উজাড় হয়ে গেছিল।
১০২১ সালে কনৌজ আক্রমণ করেন।
১০২৩ গোয়ালিয়র এর লুঠপাট চালান।
১০২৭ সালে শেষবারের মতো আক্রমণ করেন সোমনাথ মন্দিরে। বাকি সব লুন্ঠনের থেকে এর ভয়াবহতা অনেক বেশি। সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করেন তিনি। মন্দিরের সব ধনভাণ্ডার আত্মসাৎ করেন। সোমনাথ মন্দির তার এই বিপুল ধনসম্পদের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল।
৩দিন ধরে তিনি এই মন্দিরে লুঠ চালান। মন্দিরের সব সম্পদ লুঠ করেন। রাজপুত শক্তি তার বিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারা সক্ষম হননি। প্রায় ৫হাজার হিন্দু এই বর্বরতার কারণে মারা গিয়েছিলেন।
তার এই লুঠ এর পরিমাণ ছিলো প্রায় ২০ মিলিয়ন দিনার, যা বাকি সব লুঠপাটের ৮গুন। তিনি শুধু লুঠ করেই ক্ষান্ত থাকতেন না। তিনি মন্দিরে কারুকার্য ধ্বংস করেন। লিঙ্গ ধ্বংস করেন।
তিনি ভারতবাসী দের কাছে লুঠেরা হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন তার রাজ্যের এক আদর্শ রাজা। তিনি এই লুন্ঠিত সম্পদ দিয়ে তার রাজধানীকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। গজনির শ্রী বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি যে শুধু ধনভাণ্ডার লুঠ করতেই ভারতে এসেছিলেন তা কিন্তু নয়। তিনি ভারতের মহল শিল্প কর্ম স্থাপত্য ভাষ্কর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই তিনি ভারত থেকে নানা উন্নত মানের শিল্পী দের অপহরণ করে নিজের রাজ্যে নিয়ে যান নিজের রাজ্যে মহল নির্মাণ হেতু।
১২০৬ সালে মহম্মদ ঘুরির নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ভারতে বিজয় লাভ করে তরাইনের ২য় যুদ্ধে। মহম্মদ ঘুরিও প্রচুর পরিমানে সম্পদ লুঠ করেন। পরবর্তী কালে কুতুবউদ্দিন আইবকের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দাস বংস হিন্দু দের ওপর অত্যাচার চালায়।
ভারতে লুঠতরাজ শুরু হয় ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পর থেকে। মোঘল সাম্রাজ্য হলো ভারতের ইতিহাসে সবথেকে দীর্ঘদিন ধরে চলা এক মুসলিম বংস। ইব্রাহিম লোদি কে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে সিংহাসন চ্যুত করার পর তিনি ভারতের রাজকোষের চাবি হাতে পান। এর পর তিনি এই সম্পদের অপব্যবহার শুরু করেন। তিনি কেবল এই সম্পদ মুসলিম দের জন্য ব্যবহার করেন। বাবর তাঁর আত্মজীবনী বাবার নামাতে উল্লেখ করেন তিনি ছিলে ভগবানের দ্বারা প্রেরিত খোরসান, সমরখন্দ, মক্কার মধ্যে সবথেকে ধার্মিক ব্যাক্তি। তিনি তার সম্পত্তি সেনাবাহিনীর মধ্যে বিনিয়োগ করেন যার ফলে তার সেনাবাহিনী তে যোগ দেবার জন্য উতসাহ চরমে পৌছেছিল।
এই সময় মন্দির গুলিকে ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ নির্মান করার প্রবনতা দেখা দেয়। এই ক্ষেত্রে ঔরঙ্গজেব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি মথুরার মন্দির গুলি ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ নির্মান করেন। তিনি মথুরার সম্পদ লুঠ করেন।
এক দেশের সম্পদ লুঠ করে অন্য জায়গাতে স্থানান্তর এর পক্রিয়া মর্মান্তিক। এই লুঠ এর ফলে মোঘল সরকারের ওপর সাধারণ মানুষ আস্থা হারায়।
এক দেশের সম্পদ লুঠ করে অন্য এক দেশ কে সমৃদ্ধ করা ফলে কি সত্যি কি সেই দেশ সমৃদ্ধ হয়? ভারতের যে পরিমান সম্পদ লুন্ঠিত হয়েছে, ওই সম্পদ যদি ভারতে থাকতো তাহলে ভারত আরও সমৃদ্ধ হতো।
Tags: The Indian Rover