
দেবযানী হালদার একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক লেখিকা। পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের অন্যতম একজন প্রচারক তিনি। ওনার লেখা গবেষণামূলক গ্রন্থ, ‘রাম জন্মভূমি: সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা’, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশের সাথে সাথেই এসেছে ব্যাপক সাড়া — কিছু প্রশংসা ও কিছু সমালোচনা। তাই, সেই বিষয়ে আমাদের ম্যাগাজিনের পাঠকবৃন্দের অবগত করানোর জন্যে আমাদের মুখ্য সম্পাদক শ্রী তীর্থেন্দু গঙ্গোপাধ্যায় (ওরফে তীর্থ) একটি খোলাখুলি আলোচনায় যুক্ত হলেন শ্রীমতী দেবযানী হালদারের সহিত। তাদের কথোপকথনটি নিম্নে মুদ্রিত হইলো।
তীর্থ: সর্বাগ্রে, প্রণাম নিও দিদি। প্রথম বই প্রকাশ — এটার আনন্দ কেমন সেটা আমি নিজে জানি। তাই আমি জিজ্ঞেস করবো না যে তুমি কেমন আছো বা তোমার এখন কেমন লাগছে। তবে পাঠকবৃন্দের জন্য তুমিই বলো তোমার মনের অবস্থার কথা।
দেবযানী: নিঃসন্দেহে একটা অন্যরকম অনুভূতি যে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সহজ নয়। বইটা বেরোনোর পর যতটা উৎকণ্ঠা আছে, বেরোনোর আগে বের করতে পারার পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে ঠিক ততটাই উৎকণ্ঠা ছিল। প্রথম বই বলে অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। যেহেতু অত্যন্ত জটিল এবং বিতর্কিত বিষয়, সেই জন্য কিভাবে এই বইটিকে গ্রহণ করবেন সবাই, সে বিষয়ে চিন্তা তো ছিলই।
তীর্থ: আচ্ছা, “রাম জন্মভূমি : সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা” এরূপ শিরোনাম কেনো?
দেবযানী: আসলে রাম মন্দির নির্মাণের যে লড়াই হয়েছে সেটা কিন্তু ওই জন্মভূমির উপর মন্দির নির্মাণ করা নিয়ে। রাম মন্দির হাজারো নির্মাণ করা যেত। কিন্তু শ্রীরামের জন্মভূমির একটা আলাদা মাহাত্ম্য আছে। ঠিক যেমন অসংখ্য রামকৃষ্ণ মিশন থাকলেও কামারপুকুরের আলাদা গুরুত্ব আছে। আর এই লড়াই সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল, ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল। তাই এমন নামকেই আমার এক্ষেত্রে ঠিক মনে হয়েছে।
তীর্থ: যেমনটা তুমি বললে, যে বিষয়ে তুমি বই লিখেছো সেটা অত্যন্ত জটিল ও বিতর্কিত বিষয়। কখনও ভয় লাগেনি লেখার সময়?
দেবযানী: সত্যি বলতে ভয় ছিল। একটা ভয় ছিল যে যদি আমি ঠিকভাবে বিষয়টাকে উত্থাপন করতে না পারি তবে লেখা বেকার হয়ে যাবে। সবাই যাতে বুঝতে পারেন সেভাবে লেখাটাও চ্যালেঞ্জ ছিল। বহুবার লিখেছি একই জিনিষ। এছাড়া আইনি জটিলতা তুলে ধরার বিষয় ছিল। সর্বোপরি, প্রশাসনিক বিরোধিতার ভয় ছিল শুধু নয়, এখনও ভয় আছে।
তীর্থ: যতদূর আমি তোমার লেখা পড়েছি তাতে বুঝেছি যে তুমি বাংলা, হিন্দী, ও ইংরেজি এই তিন ভাষাতেই পারদর্শী। তাহলে, ইংরেজি বা হিন্দী ছেড়ে শুধু বাংলায় কেনো?
দেবযানী: হ্যাঁ তিনটে ভাষাতেই লিখতে পারলেও বাংলায় লিখি কারণ আমি যে ধরনের বিষয় নিয়ে লেখালেখি করি, বাংলা ভাষায় তা খুব কম চোখে পড়ে।
তীর্থ: একটা কথা বলো, তুমি কবে থেকে লেখা শুরু করলে বইটা? শীর্ষ আদালতের রায় বেরোনোর পর, নাকি তার আগে থেকেই?
দেবযানী: লেখার ইচ্ছে ছিল বহুদিন থেকে। তবে সুপ্রীম কোর্টের রায় ঘোষণার পর মনস্থির করি। কিন্তু কাজ শুরু করেছি ২০২০ এর এপ্রিল মাস থেকে।
তীর্থ: এই বিষয়ে কিভাবে গবেষণা করলে একটু বলো।
দেবযানী: এই বিষয়ে বাংলায় কোন তথ্য আমি পাই নি। করোনা মহামারীর সময়ে লেখা বলে সবটাই অনলাইন সোর্সের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। এখন আর্কাইভে অনেক কিছু পাওয়া যায়। পুরানো সংবাদপত্র থেকে অনেক তথ্য পেয়েছি। কিছু বইপত্র ছিল, কিছু কিনেছি। এক্ষেত্রে আমাজন কিন্ডেল খুব কাজে লেগেছে। আর সুপ্রীম কোর্টের সম্পূর্ণ রায় খুব ভাল করে পড়েছি একাধিকবার।
তীর্থ: “তোমার গবেষণায় ভ্রান্তি আছে” — যদি কেউ এই অভিযোগ করে, তাহলে তাকে কি উত্তর দেবে?
দেবযানী: আগে সে প্রমাণ করুক। তারপর আমি তথ্য তুলে ধরবো। সুপ্রীম কোর্টের বক্তব্য ভুল বলার জায়গা আছে কি?
তীর্থ: শ্রী রাম কে কি তুমি একজন শিক্ষিতা নারী হিসেবে “মর্যাদা পুরুষোত্তম” মনে করো?
দেবযানী: শ্রীরাম অবশ্যই “মর্যাদা পুরুষোত্তম”। এখানে আমার একটু আপত্তি আছে। আমার মনে করায় শ্রীরামের মাহাত্ম্য কমবেশি হয়ে যাবে না। তিনি শাশ্বত। নিজের ব্যক্তিগত সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রাধান্য না দিয়ে রাজধর্ম পালন করে গেছেন। এই চরম ত্যাগের নিদর্শনকে অস্বীকার করি কি করে? নারী বলে আমার আলাদা কোন বক্তব্য কখনো নেই। আমি সমান অধিকারের পক্ষে। একজন মানুষ হিসেবে শ্রীরাম “মর্যাদা পুরুষোত্তম”।
তীর্থ: নারীবাদীদের একাংশ শ্রী রামকে ঘৃণা করেন। সীতার প্রসঙ্গ টেনে এনে ওনারা শ্রী রামের অপমান করেন। তোমার কি মত এই ব্যাপারে?
দেবযানী: নারীবাদ কি পাশ্চাত্য ধারণা? আমার আপত্তি ঠিক এখানেই। যে দেশে পঞ্চসতী পুজিতা, সেখানে নারীবাদের নতুন সংজ্ঞা চাই নাকি? ভিক্টোরিয়ান মরালিটি দিয়ে সব কিছুর বিচার করা কতখানি প্রাসঙ্গিক? আসলে এটা এত বড় একটা বিষয় যে এই ক্ষুদ্র পরিসরে ঠিক মত ব্যক্ত করা অসম্ভব। পরে বিশদে আলোচনা হবে।
তীর্থ: “বাবরি মসজিদ” — তুমি কি দৃষ্টিতে দেখো?
দেবযানী: আমি ওই অসম্পূর্ণ কাঠামোকে মসজিদ বলে মনে করি না। সুপ্রীম কোর্টের বক্তব্য সমর্থন করি। কারণ একদিনের জন্য এখানে হিন্দুরা পুজোর অধিকার ছেড়ে দেয় নি। অন্যদিকে মসজিদ শিয়া না সুন্নী, তাই নিয়েও মামলা হয়েছে। নামাজ পড়ার প্রমাণও পাওয়া যায় না বিশেষ। কাজেই কেউ মন্দির ভেঙ্গে দিলেই মন্দিরের চরিত্র বদলে যায় না।
তীর্থ: “রাম বহিরাগত (উত্তরপ্রদেশের)। বাঙালির সংস্কৃতিতে রাম নেই” — এমন দাবি করেন অনেকে। কি বলবে?
দেবযানী: রাম বহিরাগত মানে বঙ্গদেশের মানুষ নন। অর্থাৎ এখানকার ভূমিপুত্র নন, তাই তো! ব্রাহ্মণরা কোথাকার? বিক্ষিপ্ত, বিকৃত ইতিহাস পড়ানো হয়েছে। মানুষকে ভুল বোঝানো হয়েছে। এই দেশ বরাবর এক ছিল। বহিরাগতর ধারণা আসলে বিভেদ সৃষ্টিকারী।
তীর্থ: বামপন্থীরা তোমায় বরাবর আক্রমণ করেন। কি বলবে এই বিষয়ে?
দেবযানী: আমি ভীষণ উপভোগ করি বলতে পারো। কোথাও গিয়ে যেন মনে হয়, যাক আমি একদম সঠিক পথেই যাচ্ছি।
(হেসে ফেললেন দুজনেই)
তীর্থ: সাহিত্য, শিল্প, ও গণমাধ্যমের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বামপন্থীদের দখল। এক্ষেত্রে লেখালিখির জগতে তোমায় কোণঠাসা করে দেওয়ার চেষ্টা হলে কি করবে?
দেবযানী: সে তো করাই হয়। আমার লেখা কোন সংবাদপত্রে ছাপা হয় না। লেখা চলবে যতক্ষণ না সব ইতিহাস শুধরে নেওয়া যায়।
তীর্থ: সনাতনী সমাজের সাহিত্য, শিল্প, বিশ্ববিদ্যালয় ও গণমাধ্যমে এগিয়ে আসাটা কতটা জরুরী? এর জন্য তুমি কি করছো?
দেবযানী: ভীষণ জরুরী। লোককে বোঝাতে হবে যে এই দেশের টিকে থাকার আধার সনাতন ধর্ম। আমি লেখার সাথে সাথে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত আছি। কাজ করছি। একদিন নিশ্চয়ই আমরা জয়ী হব।
তীর্থ: নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালি হিন্দুদের উদাসীনতা নিয়ে কি বলবে?
দেবযানী: এর কারণ একটা নয়, অনেক। তবে ফল হয়েছে ভয়ঙ্কর। আমরা এত পরানুকরণ প্রিয় যে নিজেদের বিশাল ঐতিহ্যের খনি চোখে পড়ে নি। ফলে কোথাও যেন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। আসলে নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতি না জানলে, কুপমণ্ডুকতা, আত্মবিশ্বাসহীনতা আসবে।
তীর্থ: এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। দেবযানী রাজনৈতিক লেখিকা এতে দ্বিমত নেই। কিন্তু কোনদিন কি প্রত্যক্ষ রাজনীতি করবে? ভোটে দাঁড়াবে?
দেবযানী: আমি রাজনৈতিক লেখিকা, এটা বোধহয় ঠিক নয়। আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করি। কিছু গল্প লেখার ইচ্ছা থাকলেও সময় নেই। আর প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে এক সময় ছিলাম। যদি আমাকে উপযুক্ত মনে করে সংগঠন, অবশ্যই দেশহিতে যে কোন প্লাটফর্মে কাজ করতে আগ্রহী।
তীর্থ: রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা RSS সম্পর্কে যে ভুল ধারণা আছে সে বিষয়ে তোমার পরবর্তী বই। একটু বলো।
দেবযানী: বইটা এখনও লেখা শেষ হয় নি। এখনি কিছু বলার সময় আসে নি।
তীর্থ: একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টেনে বলছি। মাফ করো, কিন্তু তুমি স্বামী পরিত্যক্তা, একক মাতৃত্বের ভার তোমার ওপর। দুই সন্তান, তারাও বড় হচ্ছে। সবকিছু সামলিয়ে কিভাবে লেখালিখি করছো?
দেবযানী: আমি খুব আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে একা দুই ছেলেকে বড় করছি। এই নিয়ে আমার কোন দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব নেই। গ্যাংগ্রিন হলে সেই অঙ্গ কেটে ফেলে না দিলে বাঁচা সম্ভব নয়। ছেলেরা সুস্থ পরিবেশে বড় হোক, মানুষ হোক এবং অতি অবশ্যই দেশ ও তার সংস্কৃতি ভালবেসে বড় হোক। অসুবিধা হয়। ওদের সময় দিতে পারি না। তবে প্রচুর ভাল সময় কাটাই। রান্না, ওদের পড়ানো সব করি। এবং দিনের শেষে যখন বড় ছেলে বলে যে ওরা খুব ভাল আছে, ব্যস, ওটাই তৃপ্তি।
তীর্থ: নিজের ব্যক্তিগত পরিবার ও রাজনৈতিক পরিবারের মধ্যে কোনটি বেশি প্রিয়?
দেবযানী: খুব কঠিন প্রশ্ন। দুটোর ক্ষেত্র আলাদা, দুটোই আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, দুটোই খুব প্রিয়। দুটোকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।
তীর্থ: পরিশেষে, আর প্রশ্ন করবো না। তুমি বর্তমান সময়ের নারীদের উদ্দেশ্যে কি বার্তা দিতে চাও সেটা প্রকাশ করো।
দেবযানী: নিজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখা খুব দরকারী। নিজের বাবা মা সব থেকে আপন। তেমনি নিজের সংস্কৃতি। আমি সবাইকে অনুরোধ করবো, খোলা মনে আগে জানুক সবাই। না জেনে সমালোচনা করে বোকারা। প্রকৃত সত্য জানুন। আধুনিকতা আর সনাতন ধর্ম একে অপরের শত্রু নয়, বরঞ্চ পরম মিত্র। দরকার শুধু সঠিক জ্ঞানচর্চার। ততটা উদার কি আমরা নই?
