হারানো শৈশব - সুতপা ব্যানার্জী(রায়)
তাতাই টেবিলে বসে মন দিয়ে ওর স্কুলের কাজ সেরে রাখছিল,দাদু ঘরে ঢুকতেই ওর যাবতীয় মনোযোগ দাদুর দিকে চলে গেল। গুছিয়ে গল্প করার ভঙ্গিতে দাদুর কাছে ও বায়না করল-“দাদু তোমাদের বাংলাদেশের গল্প বল না,সেই পুকুর, সেই রাধা মাধবের মন্দির সবকিছু। “দাদুভাই আগে পড়ে নাও,নাহলে তোমার মা আমায় বকবে,”দাদুর পরামর্শ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে তাড়িয়ে দিয়ে-“কও দেহি,ওসব কিস্যু হইব না।”তাতাইয়ের এই এক দোষ যে দেশ থেকে ওর দাদু মাত্র দশ বছর বয়সে চলে এসেছে,যে দেশে ওর বাবা’মায়েরও জন্ম হয় নি সেই দেশের শুধু গল্প শুনেই ও ওর কাল্পনিক ঢঙে বাঙাল ভাষায় অতি আবেগে কথা বলে ফেলে। সেমন্তী মানে তাতাইয়ের মা দাদু ও নাতির একান্তের সংলাপ শুনতে পেয়ে বলে উঠল-“কী হচ্ছে দাদু,নাতির?আবার সেই দ্যাশের বাড়ি,দ্যাশের বাড়ি খেলা?” শ্বশুরমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে অনুযোগের সুরে বলল-“বাবা,আপনিও আবার শুরু করেছেন ওকে প্রশ্রয় দেওয়া। জানেন,আপনার নাতি স্কুলে গিয়েও ঐ ভাষায় কথা বলে।ওদের ক্লাস টিচার আমায় বলছিল।” সেমন্তী চলে যেতে দাদু নাতির কাছে অনুযোগ করল-“খাওয়ালে তো বকুনি আমাকে,ওসব ভূত মাথার থেকে তাড়াও।””না মা যতই রাগ করুক আমি আমার এই খোঁজ ছাড়ব না। কাল আমাদের দেশের বাড়ির একটা ছবি এঁকেছি দেখবে?”বলে ওর ড্রয়িং খাতা বার করল তাতাই। দাদু তো ছবি দেখে অবাক,এ তো ওনার শৈশবের ফেলে আসা বাড়ির হুবহু প্রতিরূপ।শুধুমাত্র শুনে শুনেই তাতাই এই অপরূপ ছবি এঁকে ফেলেছে ভেবে বিস্মিত হল দাদু। উপহার স্বরূপ তাতাইয়ের কানে কানে বলল-“তোকে একদিন আমার জাঠতুতো দাদার বাড়ি নিয়ে যাব,উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন,এখন এপার বাংলায় থাকেন।” সব পেয়েছির আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তাতাইয়ের মুখ। ভীষণ আগ্রহ দেখিয়ে তাতাই বলল-“দাদু আমরা কবে যাব ঐ দাদুর বাড়িতে, তাড়াতাড়ি চল,আমার অনেককিছু জানার আছে ওনার কাছ থেকে।”
তাতাইয়ের ভাবভঙ্গি দেখে ওর পিঠে একটা আদরের কিল দিয়ে দাদু বলল-“ভারী এলেন আমার খুদে গবেষক রে।” দাদুর হাতটা ধরে তাতাই বায়না করতে করতে লম্ফঝম্প লাগিয়ে দিল। ওর অনুরোধ, উপরোধের সঙ্গে ঠিকমতো এঁটে উঠতে না পেরে দাদু
একদিন চুপিসারে নাতির হাত ধরে পৌঁছাল সেই জাঠতুতো দাদার বাড়ি। দাদুর সঙ্গে পথে নেমেই প্রবল উত্তেজনার মধ্যে তাতাই ওর মনে ঐ মুক্তিযোদ্ধা দাদুর একটা রূপ তৈরী করল। একটা আবছা রণাঙ্গনের ছবি ফুটে উঠল তাতাইয়ের মানসলোকে। যেখান থেকে ক্রমশ দীপ্তিময় হয়ে উঠছে ওর কাল্পনিক নতুন দাদু।দাদুর হাত ধরে যখন ঐ কল্পনার আঙিনায় ও ঢুকল তখন ওর মনটা দমে গেল একটু। তাতাই ওর মানসলোকে যে তেজময় পুরুষের কল্পনা করেছিল তার সঙ্গে তো কোন মিল নেই বাস্তবের এই দাদুর।কেমন রোগাটে,ক্ষয়াটে চেহারা। যদিও গলার স্বর বেশ জলদগম্ভীর। তাতাইকে দেখেই ভাই সত্যপ্রকাশকে বলল-“এই তা হইলে মোর খাঁডি বাঙাইল নাতি।কও কি জিজ্ঞাইবার আসে মোর লগে,কতদূর কি কইবার পারি দেহি।” তাতাই উৎসাহ পেয়ে প্রথমেই বলে উঠল-“মুক্তিযুদ্ধে তোমার ব্যবহার করা সেসব অস্ত্র আমাকে দেখাও।””তুই এট্টুস পোলা,
তয় ওসব দেহে করবি কি?”এই বলে নতুন দাদু তাতাইয়ের উৎসাহ নিভিয়ে দিতে চাইল। তাতাই আরো উৎসাহী হয়ে পড়ে বাঙাল ভাষার ফোয়ারা ছোটাল-“দেহুম না ক্যান?আমাগো দ্যাশের লড়াইয়ের অস্তরের কথা,আমি জানুম না তো কেডায় জানবে।”
জেঠু দাদু ওকে ঠাণ্ডা করতে বলল-“সে সব অস্তর কি ভিন দ্যাশে আনা যায়,ওসব ও দ্যাশে জমা দিয়ে তবে আইসি।”‘ক্যান,তুমি দ্যাশ সাড়লে ক্যান?আমাদের বেড়ানের একখান জায়গা হইত,আমরা যাইতাম,”তাতাই ফুঁসে উঠল। ওর ফুঁসে ওঠা দেখে জেঠু দাদুর নিজের রাশভারী বাবার কথা মনে পড়ল। সামান্য ভুলচুকে ছেলেদের পিঠের ছালচামড়া ছাড়িয়ে ফেলতেন। তাতাইয়ের ধরণধারণে জেঠু দাদুর পিঠের জ্বালার স্মৃতিটা ফিরে এল। পরিস্কার বাবার পায়ের খড়মের আওয়াজ দেশের সীমানা অতিক্রম করে শহর কলকাতায় জেঠু দাদুর কানে ধাক্কা দিল।সম্বিৎ ফিরতে তাতাইকে আদর করে বলল-“আমার এই সোনা দাদুভাই যদি যাইতে চায় তো আমি ব্যবস্থা করতি পারি। আমার সম্বন্ধিরা তো সব ঐ দ্যাশেই আসিল।”কারুর তোয়াক্কা না করে সটান বলল তাতাই-“আমার ও দ্যাশ যাওয়ান লাগবে,জেঠু দাদুরেই সব করতে লাগবে।” দুই দাদুই তাতাইয়ের এই বিজ্ঞের মতো আচরণ দেখে মুখ টিপে হাসল কারণ সিরিয়াস তাতাইয়ের সামনে এখন জোরে তো হাসা যাবে না। তাতাইকে নিয়ে ওর দাদু ঘরে ফিরে এসে দেখল তাতাইয়ের মামা এসেছে ওদের বাড়িতে।এই হাটের মধ্যে কি বলবে তাই তাতাই মুখ খোলার আগেই ওর দাদু বলল-“ঘুরে এলাম,আমি আর তাতাই পার্ক থেকে ঘুরে এলাম। তাতাইয়ের মামা স্বপ্ননীল তাতাইকে দেখে বলল-“এই যে আমার বাঙাল ভাগ্নে,তারপর আপনি কেমন আছেন?”তাতাই গম্ভীর হয়ে বলল-“ওরকমভাবে বললে উত্তর দেব না।” তাতাইয়ের মা শাসন করল-“ছি!তাতাই মামার সঙ্গে কেউ এমন করে কথা বলে।” স্বপ্ননীল এবার দাদুকে নিয়ে পড়ল-“মেসোমশাই এই আপনাদের দোষ,সেই ছোটবেলায় এসেও এই দেশটাকে নিজের ভাবতে পারলেন না। ও পার এখন আমাদের জন্য বিদেশ, বাঙালি অধ্যুষিত লণ্ডন বলতে পারেন।” তাতাই বাধা দেয়-“ওটাও আমাগো দ্যাশ আসিল,কাঁটাতারে ঘুসায়ে দিসে।”বেশী কথা না বলার জন্য দাদু তাতাইকে ইশারা করল। কিন্তু তাতাই একনাগাড়ে বলতে থাকল-“ঐডা আমার দাদুর দ্যাশ,আমার বাবার দ্যাশ,আমার দ্যাশ।তোমার দ্যাশ নয়,তাই তোমার গাত্রজ্বলন হয়।” দাদু হাত-পা ধোয়ার কথা বলে তাতাইকে ওর মামার সামনে থেকে সরিয়ে দিল।ছোট্ট ভাগ্নের দেওয়া অপমান সহ্য করতে না পেরে গজগজ করতে থাকল মামা-“কোথায় ইংরেজী আওড়াবি ইংরেজী মাধ্যমে পড়ে তা না হয়েছে একটা কাঠ বাঙাল,এসব তোর ঐ বাঙাল শ্বশুরের বজ্জাতি।এখন থেকে আটকা,নাহলে পরে সামলাতে পারবি না।” তাতাইয়ের মা ঠোঁট উল্টে গাত্রোত্থান করল।
মামার মোকাবিলা করে তাতাই কিন্তু বিশেষ দমল না।আরো উদ্যম নিয়ে কি করে ওপারে ফেলে আসা ওর দাদুর দ্যাশের বাড়ি দেখতে যেতে পারা যায় তার প্ল্যান করা শুরু করল। তাতাই জানে মাকে দিয়ে এ কাজ হবে না।তাই বাবাকে একাজে যেমন করে হোক সাথী করতে হবে বলে তাতাই মনস্থির করল।কদিন বাবার কাছে থেকে বাবার কাছ ঘেঁষে পড়তে বসল।দাদুর কাছে শেখা ওর জ্ঞানভাণ্ডার উপুড় করে দিল।বাবাও ছেলের পাঠ্য ও পাঠ্য বহির্ভূত সমস্ত বিষয়ের ওপর দখল দেখে মুগ্ধ হল।এই ফাঁকে তাতাই পরীক্ষার পরের ছুটিতে বাংলাদেশে ওদের পারিবারিক ভ্রমণ প্রায় পাকা করে ফেলল। ওর মা আপত্তি জানিয়ে বলেছিল-“ওখানে গিয়ে পয়সা নষ্ট না করে ব্যাঙ্কক ঘুরে এলে হয়।” যাহোক বাবা মেনে নেওয়ায় তাতাইয়ের এখন পাল্লা ভারী। সাথে দাদুকেও নিয়ে যেতে হবে এটা ছিল তাতাইয়ের অন্যতম দাবী,সে দাবীও মঞ্জুর হয়েছে, তাতাইকে আর পায় কে। দাদুর সঙ্গে সময় অসময়ে বসে পরামর্শ করে তাতাই-
“বুঝলা,ঐ জেঠু দাদুদের পরিজনদের ঠিকানা লইবা,
বলা তো যাহে না কুনটা কুন কামে লাগে। তুমার গাঁ
খান যা তুমি দশটা বসর দেহিয়াছিলে সেখান হইতেই দেহা শুরু হইব।”দাদু মজা করে বলল-“আপনে যেমন কইবেন কত্তা তেমনেই সব হইব।”তাতাই লজ্জা পেয়ে দাদুর কোলে ওর মুখ লুকোলো। পরীক্ষা শেষ হতে তাতাইরা সপরিবারে কলকাতা থেকে ঢাকা রুটের বাসে করে বাংলাদেশ রওনা হল। একই রকম পিচ রাস্তা আর রাস্তার দুধারে বড় বড় বাড়ি দেখতে দেখতে তাতাই প্রশ্ন করল-“আচ্ছা দাদু, গোটা পৃথিবীটা একরকম দেখতে?” দাদু ওকে বুঝিয়ে বলল-“আমাদের আর বাংলাদেশের মধ্যে ভূপ্রকৃতিগত মিল আছে বলে তোমার এক লাগছে।তুমি শীতের দেশে যাও,সেখানে সবকিছু অন্যরকম হবে।” দাদুর কথা তো তাতাই জলের মতো বুঝতে পারে,তাই মাথা নেড়ে চুপ করে গেল। এরপর পদ্মানদীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে তাতাইয়ের উৎসাহ দেখবার মতো। হাততালি দিয়ে বলতে থাকল-“এই নদীর ইলিশ আমরা খাই। ইস! এখানে থাকলে আরো কত ইলিশ খেতে পারতাম।কেন যে তোমরা এত সুন্দর দেশ ছেড়ে গেলে।” তাতাইয়ের শেষ কথাটায় দাদুর বুকের থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে এল। দাওয়ায় বসা ওর ঠাকুমা’ঠাকুর্দার ছবি মনশ্চোক্ষে ভেসে উঠল।ওনারা তো আমৃত্যু এই দেশে থেকে গেছিলেন, তবু কিছুই বাঁচাতে পারেন নি। ঢাকা বাস স্ট্যান্ডে নেমে প্রথমে ওরা ওদের বুক করা হোটেলে গেল। সন্ধ্যে নেমে যাওয়ায় খানিক বিশ্রাম নিয়ে কাছাকাছি নিউমার্কেট বাজার ঘুরতে গেল।তাতাই দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে সেই দশ বছরের ছেলেটাকে খুঁজছিল যে তার দাদুর সঙ্গে এই বাজারে আসত। হোটেলে খাওয়ার টেবিল দাদুর মুখে শোনা সমস্তরকম রান্নায় ভরেছিল।তবে প্রত্যেকটা রান্নাই এত ঝাল ছিল যে তাতাইয়ের খেতে অসুবিধে হচ্ছিল।
মুগের ডাল আর আলুর ভর্তা খেয়েই ওর পেট ভরে গেল। পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ল তাতাই,দাদুর সঙ্গে দাদুর জন্মস্থান দেখতে যাবে।ঢাকার সুন্দর দর্শন রিক্সা চেপে ওরা সবাই সেখানে গেল। তাতাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ওর দাদুও হতবাক হয়ে গেল এলাকাটা দেখে। কোথায় সেই দোতলা মাটির বাড়ি,কোথায় পুকুর ঘাট,রাধা গোবিন্দের মন্দির, নাট মন্দির।তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটা চারতলা স্কুল বাড়ি। তাতাইয়ের দাদু এই নতুন বিন্যাসে কোথাও নিজের অতীতকে খুঁজে পেল না।তাতাইয়ের চোখেও টলটলে জল।দাদুকে বলল-“ওরা তোমাদের বাড়িটা ভেঙে দিয়ে এসব করেছে।” তাতাইয়ের কষ্টটা বুঝতে পেরে দাদু ওকে সান্ত্বনা দিতে বলল-“দুঃখ করিস না,এখানে বাজার বা অন্যকিছু হয় নি ভাগ্যি।
স্কুলে বাচ্ছারা খেলবে,ছুটবে,ওদের মধ্যেই আমার শৈশব বেঁচে থাকবে।”
___________________________________________________________________
লেখক পরচিতি-অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা।
গৃহশোভায় আমার লেখা গল্প প্রকাশিত হয়েছে। পানাগড় থেকে প্রকাশিত কচি পাতা প্রকাশনার সংকলন,ত্রৈমাসিক সংখ্যা ও শারদ সংখ্যাতেও আমার গল্প ও কবিতা থাকে। কুসুমতরী, দিকদিগন্ত,ঝিঙেফুল,সৃজন সাহিত্য,প্রয়াস ও অপরাজিতা পত্রিকায় আমার লেখা গল্প ঠাঁই পেয়েছে। প্রচুর গল্প ও কবিতা সংকলনে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে সাহিত্যচর্চার ওয়েবজিনগুলো যেমন সাহিত্য সমগ্র, গল্পগুচ্ছ গ্রুপ, অর্বাচীন ওয়েব ম্যাগাজিন, কেয়া পাতা ওয়েব ম্যাগাজিন,বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত স্টোরি অ্যান্ড আর্টিকল,বর্ণকথা ওয়েবজিন, সময়সন্ধি ওয়েব ম্যাগাজিন,পান্ডুলিপি ওয়েব ম্যাগাজিন, ক্যানভাসে পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া প্রচলিত অ্যাপগুলিতে যেমন প্রতিলিপি বাংলা, স্টোরি মিরর, শপিজেন বাংলা, গল্প ইন-ইত্যাদিতেও নিয়মিত আমার লেখা থাকে। আমন্ত্রণমূলকভাবে দেশ ও বিদেশের বহু ফেসবুক পেজে আমার লেখা নিয়ে জড়িয়ে আছি। প্রতিলিপি বাংলা,গল্পগুচ্ছ গ্রুপ, প্রতিলিপি, গল্পের সাথী,ঋত্বিক,গল্পসল্পের আটচালা ফেসবুক পেজেও নিয়মিত আমার লেখা গল্প থাকে। সাহিত্য চর্চাই জীবনের প্রধান ভালোলাগা ও আশ্রয়।