অতীত -আজিজা নাসরিন
ছেলেরা সাধারণত কাঁদেনা, কিন্তু অনিমেষ কাঁদছে |ঝরঝর করে কাঁদছে |সে মুখ নিচু করে আছে | তার চোখের জলে বিছানার চাদরটা ভিজছে |ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটার মত করে ঝরছে তার অশ্রুবিন্দু ! মিশিকা বুঝতে পারছে না এখন তার কি করা উচিত |এর আগে সে কখন ওকে কাঁদতে দেখেনি |সে ভাবতেও পারেনি সবকিছু শুনে অনিমেষ এরকম কিছু করবে !
দু মাসের বিবাহিত জীবনে মানুষটাকে ভালোভাবে জানতে পারেনি , চিনতে চেয়েও চিনতে পারেনি | ভিতরের অস্বস্তিটা তীব্রভাবে বাধা দিয়েছে তাকে বারং বার | কষ্ট হয়েছে খুব, কিন্তু তাঁকে কিছু বলতে পারেনি| ভিতরটা যেন কুরে কুরে খেয়েছে প্রতিটা মূহুর্ত | যতবার বলতে গেছে , মুখের কথা মুখেই রয়ে গেছে | মিশিকা জানে তার এই নতুন বিবাহিত জীবনে তার নিজের আচরণ বড্ড অস্বাভাবিক , বড্ড বেমানান | অনিমেষ হয়ত ভিতরে ভিতরে মিশিকার ব্যবহারে হোঁচট খেয়ে চলেছে ! সে বার বার চেষ্টা করেছে দুজনের মাঝের সম্পর্কটা সুস্থ হোক , স্বাভাবিক হোক | কিন্তু মিশিকা সাড়া দিতে পারেনি !প্রতি মূহুর্তে অনিমেষ নিজের ভালোবাসার কথা উজাড় করে দিতে চেষ্টা করেছে | মিশিকা নিতে পারেনি |অনিমেষ তাকে এই মূহুর্তে কি ভাবছে ? কি ভাবতে পারে ? ঠকবাজ ? প্রতারক? আর ? আর কি কি ভাবতে পারে ? মিশিকার মাথায় এই দুটো শব্দ ছাড়া আর কোন কিছু মাথায় এলো না | তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে | সে চাইছে অনিমেষ এবার কিছু বলুক | যা খুশি তাই বলুক | অনেক শক্ত শক্ত কথা শোনাক তাকে| কিন্তু অনিমেষ এখনও কাঁদছে | মিশিকা লক্ষ্য করল কাঁদলে অনিমেষকে বাচ্চাদের মতো দেখায় | সে ভাবছে অনিমেষের গায়ে হাত দিয়ে ওকে ডাকবে কিনা ! ডেকে কিই বা সে বলবে ? যা বলার তা তো বলেই দিয়েছে !
কথাগুলো আরও আগে সে বলতে পারত | কিন্তু বলেনি | কিসের জন্য? নিজের ক্ষতবিক্ষত অতীত কে লুকিয়ে রাখার জন্য? নাকি অনিমেষ যদি সব শোনার পর তাকে ত্যাগ করে ..এই জন্য? দুটোই সম্ভবত ! সে জানে অনিমেষ তাকে ভালোবাসে , সে নিজেও কম কিছু বাসে না | তাই অনিমেষ কে হারানোর ভয়ও কাজ করে |
অনিমেষ ছোট্ট করে ডাকল , ” মিশি ..” |
মিশিকা নিজেকে শক্ত করল | তার শিরদাঁড়া যেন ভীষণ সোজা হয়ে বসল | মিশিকা নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করে নিল কয়েক সেকেন্ডেই, যেন এখনই সে পৃথিবীর সমস্ত রকমের শাস্তি বহন করতে পারবে ! প্রত্যুত্তরে শুধু অনিমেষের দিকে তাকিয়ে রইল তার জিজ্ঞাসু চোখ দুটি | সেই চোখে এখন কোন গ্লানি নাই ,কষ্ট নাই , দু: খ নাই , তবে সামান্য স্বস্তি আছে | অনিমেষ বলল , ” আমাকে ক্ষমা করো মিশি |”
– ক্ষমা চাওয়ার কথা তো আমার অনিমেষ |
– আমি না জেনে তোমার সম্পর্কে অন্য কিছু ভেবেছিলাম | আমি ভেবেছিলাম হয়ত তুমি আমাকে পছন্দ করো না ,হয়ত তোমার অন্য কোন প্রেমিক আছে | তাই হয়ত আমার থেকে নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রাখো | তুমি আমাকে আরও আগে বলতে পারতে মিশি !!
– আমার প্রেমিক আছে যতটা সহজে বলা যায় , “আমি ধর্ষিতা” তা সহজে বলা যায় না অনিমেষ !
কিন্তু আমি তোমার কাছে দোষ করেছি এই কথা লুকিয়ে | আমি জানি বিয়ের আগে আমার বলা উচিত ছিল | কিন্তু বিশ্বাস করো আমি বলতে চেয়েও পারিনি , ভীষণ স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম | বিয়ের দিন যখন আমার সিঁথি ভরে উঠল সিঁদুরে, ঠিক তখন থেকে আমার ভিতরটা অস্বস্তি তে ভরে উঠল |আমার আর তোমার ভালোবাসার অন্তরায় দাঁড়িয়ে রইল আমার না বলা অতীত |আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত ! আমাকে তুমি শাস্তি দাও |
অনিমেষ মিশিকার হাতটা ধরে নিজের আরও কাছে টানল তাকে , দেখল চোখদুটো শুকনো | মরুভূমির মতো ধূ ধূ করছে | সে মিশিকার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল ,” জীবনে এতবড় কষ্টটা লুকিয়ে রেখে নিজেই নিজেকে শাস্তি দিয়ে যাচ্ছ প্রতিদিন | এর উপর আমি কি শাস্তি দেব তোমাকে? তোমার শৈশবে কেউ তোমার সরলতার বড় সুযোগ নিয়ে তার বিকৃত মানসিকতা কে প্রশ্রয় দিয়ে তোমার শৈশব নষ্ট করেছে …. আর তার জন্য আমি শাস্তি দেব তোমাকে ? শাস্তি তো তার পাওয়া উচিত মিশি | তুমি কেন তোমার জীবনটা ভয় ,রাগ ,আর অস্বস্তি তে কাটাবে ?তুমি আমার স্ত্রী | আমার কাছে শেয়ার করবে ..এটাই স্বাভাবিক | আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি | মিশি ..আমার চোখের জল ঝরেছে এই জন্য নয় যে আমার স্ত্রী একজন ধর্ষিতা , এই জন্য যে আমার স্ত্রী জীবনের এতটা বছর ধরে নিজের মধ্যে এতবড় ক্ষত লুকিয়ে রেখে বড় হয়েছে ! আজ আমি তোমার শৈশব ফিরিয়ে দিতে পারব না | হয়ত পারব না সেই পাপিষ্ঠ কে শাস্তি দিতে ! কিন্তু তোমার ক্ষতকে শুকিয়ে যেতে সাহায্য তো করতে পারব ! তোমার পাশে থেকে তোমার মধ্যেকার নিজেকে নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারব | সামনের জীবনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব ! ভয় কাটিয়ে সাহস জোগাতে পারব | জীবন টাকে বাঁচার মতো বাঁচতে শেখাতে পারব |
মিশিকার ভিতরের শক্ত বাঁধন ভেঙ্গে গেল নিমেষে | নিজের কথাগুলো বলার সময়ও তার চোখে এক ফোঁটা জল ছিল না | সে সবরকম শাস্তির জন্য প্রস্তুত ছিল | অথচ অনিমেষের এই নরম কথাগুলো সে সহ্য করতে পারল না | বাচ্চা মেয়ের মত চিৎকার করে সে কেঁদে উঠল অনিমেষের বুকে |শুকনো চোখ পরিপূর্ণ হল জলে | জলের আয়নায় ভেসে উঠল ক্লাস সেভেনের মিশিকার ছবি | সে নীচ থেকে উপড়ে উঠে এসে হাফাচ্ছে | ভয় আর আতঙ্কে মুখটা কুঁচকে গিয়েছে | চেহারা রক্তশূণ্য ! মা কে রান্নাঘরে গিয়ে জড়িয়ে ধরল | সে এই মাত্র সাহেব কাকুর ঘর থেকে আসছে | সাহেব কাকু তাদের বাড়ির নীচের তলায় ভাড়া থাকে | সাহেব কাকুর কাছে সে আঁকা শেখে | আজ সাহেব কাকু যা করেছে তার সাথে, মা কে অগোছলো ভাষায় বলতে শুরু করল ,অথচ মা মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরে বললেন ,” চুপ ,চুপ … ” | মায়ের চোখেও জলের বন্যা বইছে | মেয়েকে আরও জড়িয়ে ধরেছেন | সেদিনের সেই ঘটনা মা , মেয়ে ছাড়া আর কেউ জানতে পারল না , বাবাও না | সাহেব কাকুও বে পাত্তা হয়ে গেল ! বাবা ভাবলেন ব্যাটা মাসের টাকা মেরে পালাল | মা ভাবলেন বাঁচা গেল, মেয়ের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হল | তার পর থেকে কিছুতেই মা আর মেয়ের মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে কথা হয়নি | মায়ের সাথে বিয়ের আগে এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে মা আবার চুপ করিয়ে দিয়েছে তাকে , যেন কিছুই হয়নি | হয়ত মা এই সমাজটাকে ভীষণ ভয় পায় | সঠিক বিচারের আশার থেকে সমাজের নোংরামি হয়ত বড় হয়ে উঠেছে সবার অলক্ষ্যে |
মিশিকা কতক্ষণ ধরে কাঁদছে মনে নাই | কাঁদলে হালকা লাগে | মিশিকারও লাগছে | তারপর ঘুম পায় | মিশিকার ইচ্ছা করছে সে ঘুমিয়ে পড়বে | অনিমেষ বলল , ” চলো ছাদে যাই , চার দেওয়ালের মাঝখানে কষ্টগুলো বেরোতে পারছে না , আটকে আছে | ছাদের খোলা আকাশে ওগুলো ছেড়ে দিয়ে আসি | বড় আকাশে ওরা হারিয়ে যাবে ! সহজে আর আমাদের ছুঁতে পারবে না |”
তারা দুজন সিঁড়ি বেয়ে উঠছে একসাথে | অনিমেষের হাতের মুঠোয় মিশিকার হাতের আঙ্গুল গুলো ধরা | এদের মধ্যে একজন ভাবছে , ” আমি আজ পরিপূর্ণ হলাম , একজন নারী আজ সম্পূর্ণ আমার হল , আমি তার ভরসার পাত্র হয়ে উঠতে পারলাম | সারাজীবন আমি আমার কাঁধটুকু পেতে দেব তাকে ভালো রাখার জন্য , ভালোবাসার জন্য |” আর অন্যজন ভাবছে, ” আমি অনেক ভাগ্যবতী | আমি চেয়েছিলাম ছোট্ট একটা ঘর , ভালোবাসার জন্য , অথচ তুমি বড় আকাশটাই আমাকে দিয়ে দিলে | আমার ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখব এই আকাশখানি!”
Bio :
আমার নাম আজিজা নাসরিন! বাড়ি মুর্শিদাবাদের নওদা থানার অন্তর্গত আমতলা গ্রামে! বর্তমানে আমি মেদিনীপুর শহরে থাকি ! এখানকার বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের রিসার্চ স্কলার আমি ! ভালো লাগে বই পড়তে ,নিজে লিখতে ! এছাড়া আমি গান শুনতেও খুব পছন্দ করি !
Tags: The Indian Rover