নীল আইল্যান্ড থেকে হ্যাভলকগামী ক্রুজে চেপে বেশ আরাম করে গুছিয়ে বসার তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যেই আমার যাবতীয় উৎসাহ উড়ে গিয়ে প্রবল অস্বস্তি শুরু হল। তবে এবারে কিন্তু গা-গোলানো বমনেচ্ছায় নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। হয়তো তেমন যোগাযোগ নেই, তবুও আমি একটা দুর্বল যোগসূত্র তৈরি করে ফেললাম।
আমাদের পিছনের রো’তে ডানদিকের শেষপ্রান্তে সেই ভদ্রমহিলা বসেছে। মুখের প্রায় পুরোটাই একটা কালো দোপাট্টায় ঢাকা। দৃশ্যমান শুধু চোখদুটোই। প্রথমদিন থেকেই অমনই দেখছি। আমি কোণাকুণি ডানদিকে তাকালেই দেখতে পাব ঐ মহিলার অদ্ভুত ঘোলাটে ঘিনঘিনে চাহনি। সেই দমদম এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাইটে, তারপর নীল আইল্যান্ডে আন্ডার-সি কোরাল ওয়াচিং-এর সময় পাশের বোট হয়ে এই হ্যাভলকের ক্রুজ পর্যন্ত… প্রত্যেকবার মহিলার অস্বস্তিকর উপস্থিতি। আমি অবিনের কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম সেকথা, “দেখো, সেই দমদম থেকে মহিলা আমাকে ফলো করছে।”
আমার কথা শুনে অবিন চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেই আমার কথাটা বেমালুম উড়িয়ে দিল। হেসে আমার মাথায় মাথা ঠেকিয়ে বলল, “আমার কল্পনাপ্রবণ বৌ!”
আমি অবিনের ওপরে ভারি বিরক্ত হলাম। আর কখনও ওকে আমার কোনও গোপন বিশেষ অনুভূতির কথা বলব না বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞাও করে ফেললাম। আমার চেতন ও অবচেতনের সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু এখন ঐ ভদ্রমহিলা। অবিন আমাকে লক্ষ করছে বুঝলাম। সম্ভবতঃ আমার মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরাতে অবিন নিজের পকেট থেকে বার করে আমাকে কয়েকটা ম্যাঙ্গো ফ্লেভারের ক্যান্ডি দিল। আমার খুব প্রিয়। আমি দেঁতো হেসে পাউচ ছিঁড়ে একটা ক্যান্ডি মুখে পুরলাম ঠিকই, তবে আড়চোখে ভদ্রমহিলাকে চট করে আরেকবার দেখেও নিলাম।
অবিন অনেককিছু বলে চলেছে আমার কানের কাছে। আমাদের হানিমুনের পরে এটাই সবচেয়ে লম্বা ট্রিপ। আমাদের বিয়ে হয়েছে সাত মাস। এতদিন দু’জনেই একসঙ্গে টানা ছুটি পাইনি। তাই খুব দূরে কোথাও যাওয়াও হয়ে ওঠেনি সেই হানিমুন ছাড়া। অবিন খুব উৎসাহ নিয়ে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে আমাকে দূর আকাশে উড়ে চলা কোনও সামুদ্রিক পাখি দেখাতে চাইছে। বঙ্গোপসাগরের অতলান্ত জলে ডলফিন খুঁজে চলেছে। বারবার এটা সেটা দেখাচ্ছে। আমার চোখ দুটো আপাতত সেদিকে হলেও মনে একটা গভীর প্রশ্ন উঠল… আচ্ছা, ভদ্রমহিলা কি একলা? সঙ্গী-সাথী কাউকেই তো এখনও অবধি দেখতে পাইনি। আশ্চর্য! এতদূরে বেড়াতে এসেছে একদম একলা? পরক্ষণেই মনে হল যে সে তো আসতেই পারে। সিঙ্গেল কোনও পুরুষ আসতে পারলে কোনও সিঙ্গেল মহিলা আসতে পারবে না কেন? কিন্তু ভদ্রমহিলার চোখের ঐ অদ্ভুত চাহনিটা আমাকে কিছুতেই স্বস্তি দিচ্ছে না।
অবিন আর আমি হ্যাভলকে পৌঁছে লাগেজপত্র হোটেলে রেখেই হোটেলের গাড়িতে ছুটলাম রাধানগর বিচে। পৌঁছে মনে হল এটুকু পথ হেঁটেও আসা যেত। তবে সময়টা বাঁচল এই যা। হ্যাভলকের এই রাধানগর সি-বিচটা নাকি পৃথিবীর অন্যতম স্নানের বিচ। আমি সমুদ্রস্নান বড্ড ভালোবাসি। বিস্তীর্ণ সোনালি বালুকাবেলা ছুঁয়ে বঙ্গোপসাগরের স্বচ্ছ জল অবিরাম সফেন ঢেউ ভাঙছে। ক্রিসমাস ইভ চলছে। ছুটির মরশুম। তাই দেশি বিদেশি স্নানার্থীদের বেশ ভিড়। আমি নীল আইল্যান্ডে সমুদ্রে নামিনি। সেদিন শরীরটা একদম ভালো ছিল না। পোর্টব্লেয়ার থেকে নীল আইল্যান্ড যাবার ক্রুজে খুব বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তবে এদিনে হ্যাভলকে আসার সময় ক্রুজে কিছু হয়নি। সমুদ্রের জলে নীল আকাশের গাঢ় ছায়ায় জলে নীলাভা মিশেছে। মুগ্ধ আমি অবিনের কাছে আমার পোশাকের ব্যাগটি রেখে সুইম-স্যুটের ওপরে তোয়ালে জড়িয়ে দুদ্দাড়িয়ে ছুটে নেমে গেলাম মনোহারিনী রাধানগর বিচের নাতিশীতোষ্ণ জলে। সদ্য কিশোরীর মতো উচ্ছ্বসিত আমি। আমার অমন কাণ্ড দেখে অবিন পাড় থেকে হাত নেড়ে নেড়ে হাসছে। দূর থেকেও ওর চকচকে দাঁতগুলো দেখতে পাচ্ছি। ঝকঝকে রোদ পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে। আসলে আমাকে খুশি দেখলেই অবিন খুশি খুশি হয়। আমি আরও উৎসাহিত হয়ে উচ্ছ্বাসে ভেঙে ভেঙে গলে পড়ছি ঢেউ ভাঙার তালে তালে। উৎসাহের আতিশয্যে আমি তখনকার মতো সেই অস্বস্তিকর চাহনির ভদ্রমহিলার কথাও বেমালুম ভুলে যেতে চাইলাম। অবিন ঠিকই বলেছে। আসলে আমি তো বেশ কল্পনাপ্রবণই!
সমুদ্র আমার বড় প্রিয়। সমুদ্রের জল আমার বড় প্রিয়। সমুদ্রের ঢেউ আমার বড় প্রিয়। সমুদ্রের আদিগন্ত বিস্তৃত বিশালতা আমার বড় প্রিয়। সমুদ্রের জলে নামলে আমার সময়ের জ্ঞান থাকে না। আমি নিজেকে উল্টেপাল্টে জলে ভাসছি, নামছি, উঠছি ঢেউয়ের দোলায়। কী আনন্দ! কী আনন্দ! অবিনটা যে কী না! সমুদ্রে স্নান করতে চাইল না। কিছুতেই জলে নামতে চাইল না। বুড়িয়ে যাচ্ছে যেন। কম্পিউটারের স্ক্রিন আর কী-বোর্ড বাদে আর কোথাও অবিন তেমন স্বচ্ছন্দ নয় যেন। আজকাল বিছানাতেও গতানুগতিক। উচ্ছ্বসিত হয় না। একটাই ছুতো ওর সর্বক্ষণ… অবিনের খুব কাজের চাপ। অথচ বিয়ের আগে? কতবার রাত ভোর হয়েছে, তবুও অবিন ক্লান্ত হয়নি। হয়তো পরদিনই দু’জনেরই নাইট শিফট, তাও অবিন কোনও তোয়াক্কা করেনি। আমাদের সম্পর্কটা প্রাথমিকভাবে শুরু হতে একটু বেশি সময় নিলেও, তারপর কিন্তু সম্পর্কটা উদ্দাম গতি পেয়েছিল। পাক্কা পাঁচ বছরের প্রেমপর্বে রাতের পর রাত ডুবুরির মতো আমার শরীরী রহস্য সন্ধান করে বেড়িয়েছে অবিন। আমার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। হয়তো অবিনের এই পরিবর্তনটাও স্বাভাবিক। জানি না। তবুও অবিনকে ভীষণ ভালোবাসি। বন্ধুরা আমাকে ক্ষেপায়। তা হোক। তবুও আমার অবিন খুশি থাকুক। থাকগে, যেমন ওর ইচ্ছে তেমনভাবেই থাকুক, বিয়েটা তো অবশেষে করেছে। ভালোও বাসে। নিজের মতো করে। আর তাছাড়া এখনও অবধি আমার প্রতি অবিনের দায়িত্ব কর্তব্য পালনেও কোনও ঘাটতি নেই। শরীর নিয়ে অভিযোগটা তাই খুব একটা করি না আমি।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। পৌষ মাস। হাওয়ায় একটা শীতল টান। হ্যাভলকের রাধানগর সমুদ্রসৈকতেও বেশ গা শিরশিরানি। মাথার ওপরে সূর্যের অবস্থান দেখে বুঝলাম যে অনেকক্ষণ জলে নেমেছি। হালকা শীত শীত করছে। এবারে উঠতে হবে। পেছন ফিরে বিচের বালিয়াড়িতে তাকালাম। অবিন কোথায় গেল? নিশ্চয়ই কাছেপিঠে গেছে কোথাও। আসার সময় কয়েকটি ছোট ছোট ড্রিঙ্কস্-স্টল দেখেছিলাম। কফি, ডাব, কোক, বিয়ার… সবই পাওয়া যাচ্ছে। নির্ঘাৎ ওখানেই গেছে। একলা বসে থাকতে থাকতে বোরিং ফিল করছিল হয়তো। যাকগে, ফিরবে এখনই। জানে তো আমি সহজে জল ছেড়ে উঠব না। আমি আবার ঢেউয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম।
একটা খুব বড় ঢেউ আসছে। সবাই হৈচৈ করছে। ভিড় ছাড়িয়ে একলা আমি আরও একটু গভীর জলে চলে গেলাম। ঢেউটা একটা সুড়ঙ্গের মতো হয়ে পাক খেয়ে সশব্দে আছড়ে পড়ার মুহূর্তে ডুব দিলাম আমি। জলের তলায়। আমার শরীরের উপর দিয়ে যেন শত শত আঙুল বুলিয়ে ঢেউটা চলে যাচ্ছে। এ সমুদ্রের স্পর্শ না পৌরুষের স্পর্শ? শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে যাচ্ছে। ঠিক যেন অর্গ্যাজমের আগের মুহূর্তে। শরীর শিথিল হয়ে আসছে। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার গলায় খুব জোরে একটা চাপ। ঠিক যেন সাঁড়াশির মতো। দমবন্ধ হয়ে এল। চোখটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে দেখতে পেলাম সেই ভদ্রমহিলার সেই অস্বস্তিকর চোখদুটো।
ঢেউয়ের গর্জনে ভেঙে যাওয়া ফ্যাঁসফেঁসে গলায় হিসহিস করে মহিলা বলল, “কী? কেমন লাগছে? জলের তলায়? কলকাতার ক্লাবের সুইমিং পুলের তলার থেকে ভালো নিশ্চয়ই। চুরচুর নেশা করিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছিলে তো? আমি কিন্তু অতটা নীতিজ্ঞানহীন বেরসিক নই। তাই তোমাকে ডোবানোর জন্য তোমার প্রিয় সমুদ্রই বাছলাম। লম্বা প্ল্যানিং করে আমাকে তুমি অবিনের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েছ, তাই আমিও তোমাকে অবিনের কাছ থেকে সরিয়ে দিলাম। সব জলের তলাই একরকম। বেশিক্ষণ থাকলেই দমবন্ধ শীতল। দেখেছ? চলো, আমরা পাশাপাশি শুয়ে থাকি। এখানে অবিন থাকবে না। শুধু তুমি আর আমি… আমি আর তুমি।”
আহা, আমি কী শান্তিতে শুয়ে আছি জলের তলায়! চোখে রাজ্যের ঘুম। আমার পাশে শুয়ে সেই ভদ্রমহিলা। এখন আমরা দু’জনেই পাশাপাশি শুয়ে ঘুমন্ত। ঘুমিয়ে পড়ার আগে ওর পুরো মুখটা আমি দেখতে পেয়েছি। চিনতেও পেরেছি। ওতো অবিনের প্রথম স্ত্রী পৌষালি।