The Indian Rover (Issue: October, 2021)
বিষাদ ছুঁয়েছে যাকে (পূজো সংখ্যার জন্য) - অপরাজিতা চিত্রলেখা

মোবাইল স্ক্রিনে সময় দেখলো, দশটা তেত্রিশ। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, চোখে রোদচশমা। রানাঘাট-শিয়ালদা রেললাইনের গা বরাবর সরু পিচমোড়া রাস্তাটা ধরে হেঁটে আসছিলো পর্ণা। মধ্য জুনের রোদ যেন আগুনের প্রপাতের মত নেমে আসছে আকাশ থেকে। প্রায় সারারাত জেগে থাকার ধকল পর্ণার শরীরে, চলার ছন্দে। তবু হাঁটার গতি বাড়ালো পর্ণা। তিতিরকে কতক্ষন দেখেনি! গতকাল সন্ধ্যা নাগাদ তাকে হোমওয়ার্ক করিয়ে, খাইয়ে- দাইয়ে, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে বলে, বেরিয়ে গিয়েছিলো পর্ণা। প্রত্যেকদিন না হলেও সপ্তাহে চার-পাঁচদিন তাকে বেরোতে হয় তিনটে পেটের দায়ে। পর্ণা, তিতির আর সৌমিকের অনেক দূর সম্পর্কের এক পিসি। নাঃ, সৌমিক আর ওদের সঙ্গে থাকে না।
ডোরবেলের আওয়াজ শুনেই ছোট্ট খরগোশের মত লাফাতে লাফাতে দরজার কাছে ছুটে এলো আট বছরের তিতির। পর্ণা আলতো করে ছোট্ট একটা টোকা দিলো তার গালে। বাইরের জামাকাপড়ে পর্ণা কক্ষনো তিতিরকে আদর করে না। পর্ণা মনে করে সারা রাজ্যের নোংরা, আবর্জনা লেগে থাকে তার এই জামাকাপড়ে, যার এতটুকু কণাও সে তিতিরের ধারে কাছে আসতে দিতে চায় না। ব্যাগ ও সানগ্লাস বাইরের ঘরে ছোট টেবিলটার ওপর রেখে চট্ করে কলঘরে ঢুকে পড়ে পর্ণা।
দু’গামলা জলের সবটুকু গায়ে ঢেলে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পর্ণা ভেজায়। তারপর আরো এক গোটা বালতি পুরো উপুড় করে দ্যায় মাথায়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে জলের শীতল ধারা। নিঃস্ব, রিক্ত পর্ণা আবার সজীব হয়ে ওঠে। ঠিক যেমন, প্রায় শুকিয়ে যাওয়া গাছে আবার প্রাণ সঞ্চার হয় বর্ষার জল পেয়ে। স্নানের সময়টুকু বড় প্রিয় পর্ণার। সে গুনগুনিয়ে গাইতে থাকে- “জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো…” দরজায় দুটো ছোট ছোট হাতের ধাক্কা পড়ে, “মা, মা”
পুরোনো একটা ফেড হয়ে যাওয়া সাদা তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে পর্ণা ঘরে ঢোকে। এটা তার আর তিতিরের শোবার ঘর। জীবনের প্রবহমানতা মেনে নিয়ে আগের অনেক কিছুই ছেড়ে দিয়েছে পর্ণা, অথচ কেন কে জানে এই তোয়ালেটা আজও ছাড়েনি। সৌমিক চলে যাওয়ার সাত বছর পরেও। তখন সৌমিকই ব্যবহার করতো তোয়ালেটা। আজও যেন এতে লেগে রয়েছে সৌমিকের হাতের, চুলের, শরীরের স্পর্শ।দক্ষিণের জানলাটার কাছে দাঁড়িয়ে ভাবনায় হারিয়ে যায় পর্ণা। কি হবার কথা ছিলো আর কি হয়েছে জীবন!
গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে ভর্তি হয়ে ছিল ইংরাজিতে মাস্টার্স করবে বলে। বাবার স্বপ্ন ছিলো একদিন সে ইংরাজির অধ্যাপিকা হবে, নিদেনপক্ষে স্কুলের দিদিমণি তো বটেই। মায়ের মতো গানটাও বড় ভালো গাইতো সে। বিশেষত রবীন্দ্র সংগীত।
ইউনিভার্সিটিতে পর্ণার সবথেকে প্রিয় বন্ধু ছিল রণিতা। ক্লাসে কিংবা ক্লাসের বাইরে সবসময় দু’জনে একসঙ্গে থাকতো। একে অপরের বাড়িতেও অবাধ যাতায়াত। ঝকঝকে, সপ্রতিভ সুন্দরী রণিতাকে পর্ণার বাবা-মা খুবই পছন্দ করতেন। সে যেন খরস্রোতা নদী, খলবলে, দুরন্ত। অন্যদিকে ধীর, স্থির, শরতের সকালের মত মনোরম সৌন্দর্যের অধিকারী পর্ণা, রণিতার বাড়ির সকলের প্রিয়। পার্ট ওয়ানের টেস্ট পরীক্ষার সপ্তাখানেক পর রণিতা আর পর্ণা হেঁটে আসছিলো চিড়িয়া মোড় দিয়ে। ফুটপাতের একটা চা এর দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলো কতকগুলো বখাটে ছেলে। সৌমিক ছিলো ওদের লিডার গোছের। সেদিন চা খেয়ে চা এর ভাঁড় টা সৌমিক ছুঁড়েছিলো না দেখেই। অতর্কিতে ভাঁড় টা এসে পড়েছিলো পর্ণার পায়ের কাছে। সৌমিক উঠে এসে ক্ষমা চেয়েছিলো পর্ণার কাছে। তাতেও রণিতা বেশ কয়েকটা গরম গরম কথা শুনিয়েছিলো সৌমিককে। তারপর থেকেই রণিতা আর সৌমিকের প্রেম। ওরা গল্প করতো ঐ চা এর দোকানের সামনে, সিঁথির মোড়ের নির্জন মাঠে ঘন্টার পর ঘন্টা। কখনো হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসতো ডানলপে, আবার কখনো হারিয়ে যেত দূরে কোনো পার্কে বা সিনেমা হলে। এই সময় পর্ণাকে হয় দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো নয়তো ক্লাসে সময় কাটাতে হতো একা একা। এভাবে মাস ছয়েক চলার পর প্রেমের নদীতে জোয়ার সরে গিয়ে ভাঁটা এলো। রণিতার বেশিদিন ভালো লাগলো না ক্ষ্যাপাটে টাইপের সৌমিককে। ও তখন সদ্য সদ্য মজেছে তরুণ অধ্যাপক নীলোৎপল বাসুর প্রতি। একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে একা ফেরার পথে পর্ণাকে নাম ধরে ডেকে দাঁড় করালো সৌমিক। হাউহাউ করে কাঁদলো পর্ণার হাত ধরে। তারপর আরো কয়েকদিন। রণিতার প্রতি ওর অভিমান অভিযোগগুলো পর্ণার কাছেই উগরে দিতো সৌমিক। এভাবেই আস্তে আস্তে পর্ণা কখন যেন সৌমিকের দুঃখের সাথী হয়ে উঠলো। সৌমিকের এক গাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি, প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার দেবদাস-দেবদাস বিষণ্ণতা, আবার ছোট ছোট আনন্দে শিশুর মত উচ্ছল হয়ে ওঠা, পর্ণাকে বেঁধে ফেলছিলো আস্তে আস্তে। প্রিয় বন্ধুর ফেলে যাওয়া প্রেমিককেই একদিন ভালবেসে ফেললো পর্ণা। তখন তার ফাইনাল ইয়ার। বাবা যেদিন জানলেন, বন্ধ করে দিলেন মেয়ের কলেজ যাওয়া। দু’চারদিন বাড়ির মধ্যে বন্দী থেকে, ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক সাতদিন আগে একদিন ভোর রাতে বাড়ি ছাড়লো পর্ণা, বাবা-মাকে একটা চিঠি লিখে। নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবন, সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন আশা জলাঞ্জলি দিয়ে পর্ণা বেছে নিলো অনিশ্চয়তায় ভরা সৌমিকের ভালবাসার ভরসাকে।
দুপুরে ভাতঘুমের অভ্যাস কোনোদিন ছিলো না পর্ণার। সেই স্কুলজীবন থেকেই। তবে এখন রাত জেগে কাজের জন্য, দুপুরে তিতিরকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে একটু ঢুলুনি আসে। তিতিরের পাশে শুয়ে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলো পর্ণা, ফোনটা বেজে উঠলো টিংটং করে। ঘুম চটকে গেলো পর্ণার। উঃ, সেই 91104—-, কাস্টমার কেয়ার। তিতিরের মাথার নীচ থেকে আস্তে আস্তে বাম হাত টা বের করে পর্ণা আয়নার কাছে এসে দাঁড়ালো। খুব ভালো করে দেখতে লাগলো নিজেকে। মেদহীন ছিপছিপে শরীরটা আজও আকর্ষণীয়। চটকদার ব্যাপারটা কোনোদিনই ছিলো না তার। তার সৌন্দর্য ভোরের প্রকৃতির মতো। চোখকে আরাম দ্যায়। চোখের চারপাশটা খুব ভালো করে দেখলো সে। হ্যাঁ, এই তো হালকা কালচে ছোপ তার গভীর জলাশয়ের মত দুটো চোখকে ঘিরে। পর্ণা প্রশ্ন করলো নিজেকে, “এটা কি দীর্ঘ রাত জাগার চিহ্ন, না কি যে জীবন সে বুকে করে বয়ে বেড়াচ্ছে, তার গ্লানির ছাপ!! কোনটা??” পর্ণার চোখের কোণটা চিকচিক করে উঠলো। কিন্তু নাঃ, সে কিছুতেই নিজেকে দুর্বল হতে দেবে না। শত ঝড়, ঝঞ্ঝা, মেঘ, বৃষ্টি সে বুক দিয়ে আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে এতদিন শক্ত হয়ে, কর্তব্য পালনের লড়াইতে সে হেরে যায় নি। এই সত্যিটাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতদিন, শরীরে এত কালিমা মেখেও। জীবনে লক্ষ লক্ষ আশা প্রতিনিয়ত জন্মায় আবার মরেও যায়, তবু টিকে থাকে জীবন। টিকে থাকার নাম কি বেঁচে থাকা?? পর্ণা ভাবতে থাকে।
সৌমিক অসুস্থ হয়েছিলো দীর্ঘদিন। তখন তিতির তিন মাসের। তিতিরের দুধ, সৌমিকের ওষুধ, বাড়ি ভাড়া, তার নিজেদের দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়া-পরা জমানো টাকায়, অল্প দু-একটা গয়না যা তার গায়ে ছিলো বছরের পর বছর সেগুলো বিক্রি করেও আর চালাতে পারছিলো না পর্ণা। সংসারের অভাব অনটন বিরাট দৈত্যের মতো গ্রাস করেছিলো তাকে। তবু পর্ণা হাল ধরে থেকেছে। সৌমিককে দুর্বল হতে দ্যায় নি, নিজেও নিস্তেজ হয়ে পড়ে নি শরীরে-মনে। কষ্ট পেয়েছে তখন যখন সৌমিককে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখেছে। অপরাধী ভেবেছে নিজেকে, মনে মনে, কিছু না করতে পারার অক্ষমতায়। তারপর বেরিয়েছে পথে, ছুটে বেরিয়েছে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, একটা কাজের জন্য। সৌমিক একটা প্রাইভেট ফার্মের অ্যাকাউন্টসে কাজ করতো। পর্ণা ছুটে গেছে সেখানেও। অল্প কিছু টাকা এবং আশ্বাস মিলেছে। কোথাও কোনো ব্যবস্থা করতে না পেরে পর্ণা যখন দিশাহারা, তখন একটা কাজের খবর নিয়ে এলেন রঞ্জিত বাবু, সৌমিকের কলিগ। আগেও দু চারবার এসেছেন সৌমিক সুস্থ থাকতে। সৌমিকের খুব উচ্ছ্বাস ছিলো ভদ্রলোক সম্পর্কে, তবে পর্ণার খুব একটা পছন্দ হতো না ভদ্রলোকের হাবভাব, চালচলন। এহেন রঞ্জিত বাবুই একদিন এলেন পর্ণার চাকরির সুখবর নিয়ে। বেসরকারি সংস্থায় কাজ, মাইনে ভালো। আর কিছু শোনার আগেই রাজি সৌমিক। বাকি টুকু পর্ণা জানলো পরের দিন ইন্টারভিউয়ে। রাতে কাজ, ওদের কথামতো পর্ণাকে দাঁড়াতে হবে ক্যামেরার সামনে, নানা ভঙ্গিতে, নগ্ন হয়ে। পর্ণা হতভম্ব। তার শিক্ষা- দীক্ষা, যোগ্যতা কোনো মান্যতা পেল না তবে! মনেপ্রাণে প্রবলভাবে না বলে দিতে চাইলো সে। ঠিক তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সৌমিকের রোগক্লিষ্ট মুখ, তিতিরের খিদে পাওয়ার কান্না…
একটু একটু কথা বলতে শিখেছে তিতির।টলোমলো পায়ে হেঁটে বেড়ায় দুটো ঘরে, এক চিলতে বারান্দায়। সৌমিকও অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। পেটের তীব্র যন্ত্রণাটা আর হয় না। প্রায় ছ’মাস হয়ে গেল পর্ণা চাকরি করছে। রাতে ডিউটি, আবার সারাদিন রান্নাবান্না, ঘরের কাজ, সৌমিকের সেবা, তিতিরের যত্ন – নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে ওর। তাই একদিন সৌমিকের সঙ্গে আলোচনা করেই নিয়ে আসা হল সৌমিকের দূর সম্পর্কের এক বিধবা পিসিকে। এখন কিছুটা রেস্ট পায় পর্ণা। যদিও সৌমিকের আর তিতিরের সেবা যত্নে সে কোনো ত্রুটি রাখে না, নিজেই করে। সৌমিক আর তিতিরের খুশিতে উজ্জ্বল মুখগুলো দেখেই পর্ণা খুশি। এর থেকে বেশি কিছু সে চায় না। কিন্তু পর্ণার জীবনে সুখ ক্ষণস্থায়ী। সব সুখ তছনছ হয়ে গেলো সেদিন, যেদিন সৌমিক সব জানতে পারলো। একরাশ ঘৃণা আর এক দলা থুতু ছুঁড়ে দিলো পর্ণার মুখে। বললো, “নোংরা মেয়েছেলে! তোমাকে আমার স্ত্রী বলে ভাবতে ঘেন্না করছে। ছিঃ”, পর্ণা বোঝাতে পারে নি, স্বামী সন্তান আর তার ভালবাসার সংসারটাকে বাঁচানোর জন্যই সে-সৌমিক চলে গিয়েছিলো সেদিনই, পর্ণাকে আর এক বছরের তিতিরকে অন্ধকারে ফেলে রেখে। বলে গিয়েছিলো, “এখন সব বুঝতে পারছি, এসবই তোমার শরীরের খিদে মেটানোর ছল। আমার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে তুমি রাতের পর রাত—ছিঃ”
সদ্য সুস্থ সবল হওয়া সৌমিক জোরে একটা লাথি মেরেছিলো পর্ণাকে। পর্ণা ছিটকে পড়ে গিয়েছিলো আলমারির কোণে। হাতের কনুই এ, মাথায় জোর লেগেছিলো তার। শরীরের থেকেও বেশি আঘাত লেগেছিলো মনে। পর্ণা ওঠে নি, উঠতে পারে নি সৌমিক যখন সব গোছগাছ করে চলে গেলো। পর্ণা ভাবে, মহাকাব্যে বা পুরাণে তো নারীরা স্বামীকে বাঁচাতে বা বংশ রক্ষার্থে বহুগামিনী হয়েছে, নগ্ন হয়েছে পর পুরুষের সামনে। তারপরেও তো তারা সতী, পূজনীয়া। আর বাস্তবে সতী শব্দটাই কেমন যেন মরীচিকা। সৌমিককে কোনোদিনই বোঝাতে পারবেনা পর্ণা যে, নগ্ন হয়েছে তার শরীর, মন নয়।
ঘুমোচ্ছে তিতির। কি নিষ্পাপ সুন্দর মুখ ! পর্ণা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সন্তানের দিকে। লড়ে যাবে সে, তিতিরের জন্য, সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে। পর্ণার আজ আর কোনো পরিচয় নেই। সে কারো মেয়ে নয়, কারো বৌ নয়। সে শুধু একজন মা। তিতিরকে মানুষ করবে পর্ণা, মানুষের মত মানুষ। তার জন্য কোনো অবস্থাতেই হারবে না সে। পর্ণার বুকের ভেতর প্রবল একটা জেদ তৈরি হতে থাকে। আকাশের বুকে মেঘ জমছে। বছরের প্রথম বর্ষার মেঘ। খোলা জানলার পাল্লা দুটো নড়ছে। হয়তো বৃষ্টি আসবে। আকাশ ডাকছে গুরগুর করে। তিতির ঘুমের মধ্যে চমকে উঠলো একবার। তারপর একবার চোখ মেলে মাকে পাশে বসে থাকতে দেখে জড়িয়ে ধরলো, মুখ ডুবিয়ে দিলো মায়ের কোলে।