কোনারকের সূর্যমন্দিরের গুপ্তকথা - সুমিত বণিক

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ সূর্যের উপাসক ছিল । তাই সূর্য দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে তার জন্য মানুষ তৈরি করেছে শত শত উপাসনালয় । সূর্য দেবতার উপাসনার নিমিত্তে তৈরি এসব মন্দিরকেই বলা হয় সূর্য মন্দির । দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পাওয়া সূর্য মন্দিরগুলির মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন , সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় মন্দিরটি অবস্থিত ভারতবর্ষের উড়িষ্যা রাজ্যের কোনার্ক শহরে । পুরী ভ্রমনে গিয়ে কোনারকের সূর্য মন্দির না দেখলে পুরী জেলার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হতে হয় । কোনারকের সূর্যমন্দির কেবল পুরীর নয় , সমগ্র ভারতের একটি অপূর্ব সম্পদ । কোনো কোনো কারনে তাকে সারা পৃথিবীতেই অতুলনীয় বলা চলে । একদিকে জগন্নাথের মন্দির , আর একদিকে কোনারকের মন্দির , মাঝখানে ধূ ধূ করছে আঠারো মাইল ব্যাপী বৃক্ষশূন্য মরু-প্রান্তর । বালি আর বালি , মাঝে মাঝে দেখা যায় বড় বড় বালির পাহাড় । এই দিগন্ত বিস্তৃত বালুকারাজ্যের অপরিসীম শুষ্কতাকে সরস করবার চেষ্টা করে ছোট একটি নদী । মরুপ্রান্তরের প্রান্তে দেখা যায় কবির মনোরম স্বপ্নদৃশ্যের মতো একটি তরুশ্যামল কুঞ্জবন । তারই ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে কোনারকের দেবতাহীন ভাঙা মন্দির । ভাঙা বটে , কিন্ত কী অসাধারন সুন্দর ।
“কোনার্ক” কথাটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ “কোন” এবং “আর্ক” থেকে , যার অর্থ সূর্যের কোন । মন্দিরটি হল এয়োদশ শতাব্দীতে নির্মিত একটি হিন্দু মন্দির যা উৎসর্গ করা হয়েছে সূর্য দেবতাকে । মন্দিরটির আকৃতি হল একটি বৃহদাকার রথের মতো । সমগ্র মন্দিরগাত্রে সৃষ্ট সূক্ষ্ম প্রস্তর ভাষ্কর্যের জন্য মন্দিরটি প্রখ্যাত । পুরী থেকে ৩৫ কিমি উত্তরে কোনারক নামক গ্রামে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ত্রয়োদশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে উড়িষ্যার গাঙ্গ বংশীয় রাজা প্রথম নরসিংহদেব মন্দিরটি নির্মান করেছিলেন । ইউরোপীয় নাবিকদের বিবরণে এটি “ব্ল্যাক প্যাগোডা” নামেও পরিচিত , কারন দূর সমূদ্র থেকে মন্দিরটিকে একটি কালো মিনার বা কালো বুরুজের মতো দেখাতো । মন্দিরটির স্থাপত্যশৈলী অনন্য । ১২ জোড়া অলংকৃত চাকা এবং সাতটি তেজী ঘোড়া দ্বারা চালিত রথের আকারে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে।

কোনার্ক মন্দিরের স্থাপত্যকলা :
কোনারক সূর্যমন্দির নির্মিত হয়েছে ভারতীয় মন্দির শৈলীর কলিঙ্গ রীতি অনুসারে , যার বৈশিষ্ট্য হলো বক্ররেখা–বেষ্টিত শিখর ও তার ওপর একটি ছোট্ট প্রাসাদ–গুম্বজ । আকৃতির দিক থেকে মন্দিরটি উড়িষ্যার অন্যান্য শিখর মন্দিরের সমতুল্য । কোনারক মন্দিরের গরিমা প্রতিফলিত হয়েছে তার উচ্চতায় । মুখ্য মন্দিরের (বিমান) উচ্চতা ছিল ২২৯ ফুট, যার অস্তিত্ব এখন আর নেই এবং জগমোহনের (দর্শক কক্ষ) উচ্চতা হল ১২৮ ফুট । তার সঙ্গে রয়েছে বিশদ স্থাপত্য অলংকরন । মুখ্য দেবালয়ে অধিষ্ঠাতা দেবতার মূর্তির জন্য পবিত্র বেদীটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে । মন্দিরের দর্শক–কক্ষটি অক্ষুন্ন রয়েছে কিন্তু নাটমন্দির ও ভোগমন্ডপের সামান্য অংশই সময়ের প্রভাবকে অতিক্রম করে টিকে আছে । সমগ্র মন্দির প্রাঙ্গণের আয়তন হল ৮৫৭ ফুট × ৫৪০ ফুট । কোনার্ক সূর্যমন্দির কেবল একটি মন্দির নয় । একটি রাজপ্রাসাদের যেমন ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভবন থাকে , তেমনি এখানে একাধিক মন্দির ও স্থাপনা ছিল , যেগুলির ধ্বংসাবশেষ এখনো দেখতে পাওয়া যায় । এই স্থাপনাগুলি হল :
* মায়াদেবী মন্দির : ১৯০০ সালে কোনার্ক মন্দির চত্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময়ে মায়াদেবী মন্দির আবিস্কৃত হয় মন্দিরের মূল প্রবেশপথ থেকে পশ্চিমদিকে এর ধ্বংসাবশেষ এখনো টিকে আছে । কোনার্ক সূর্যমন্দিরের আগেই এটি নির্মিত হয়েছিল । খুব সম্ভবত একাদশ শতকে মায়াদেবী মন্দির নির্মিত হয় এবং এটিও একটি সূর্যমন্দির ছিল ।
* বৈষ্ণব মন্দির : ১৯৫৬ সালে এটি খনন করে উন্মোচন করা হয় । এটি নিশ্চিতভাবেই একটি পরিপূর্ণ মন্দির ছিল । এর গঠন প্রকৃতির সঙ্গে মায়াদেবী মন্দিরের গঠনের মিল পাওয়া যায় এবং দুটি মন্দিরের নির্মাণকালও একই । তবে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক মতামত দিয়েছেন যে মায়াদেবী মন্দিরটি আসলে পৃথক কোনো মন্দির নয় , সেটি এই বৈষ্ণব মন্দিরেরই অংশ ।
* ভোগ মন্ডপ : মন্দিরের দক্ষিণ দিকে রয়েছে “ভোগ মন্ডপ” নামক একটি বিশাল খাবার ঘর । পুরোপুরি খননের পর প্রত্নতাত্ত্বিকগন বিস্মিত হয়েছিলেন এর গঠন এবং পরিচালনার ধরন দেখে । এখানে মূল খাবার ঘর ছাড়াও খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষণের জন্য এবং রান্নার জন্য দুটি পৃথক ঘর রয়েছে । তাছাড়া ঘরের সাথে জল নিষ্কাশনের নালা এত চমৎকারভাবে করা হয়েছে যে শত শত মানুষের ভোজন সম্পন্ন হবার পর ময়লা জল কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে নালা দিয়ে মন্দিরের বাইরে পাঠানো সম্ভব । অতিথিদের সুবিন্যস্তভাবে বসানোর জন্যও আছে বিশেষ ব্যবস্থা । তাছাড়া রান্না ঘরের কাছেই রয়েছে দুটি গভীর কূপ , যেগুলি জল সরবরাহ করতো ।



কোনার্ক মন্দিরের স্থাপত্যকলা
কোনার্ক মন্দিরের ভাস্কর্যকলা :
মুখ্য মন্দিরের প্রাচীর গাত্রে উৎকৃষ্ট ভাস্কর্য খোদিত । মুখ্য মন্দিরের অগ্রভাগে রয়েছে একটি নাট্য মন্ডপ । বলা হয় যে , মন্দিরটি সূর্য দেবতা দ্বারা শাসিত সময়ের অতিবাহনকে চিহ্নিত করে । মনে করা হয় যে , মন্দিরের ৭ টি ঘোড়া সপ্তাহের সাত দিনকে চিহ্নিত করে এবং ১২ জোড়া চাকা বৎসরের ১২ টি মাসকে নির্দেশিত করে । গভীর অর্থপূর্ণ কোনারক মন্দিরের এই প্রতীকী কার্যগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । দেউরি অতিক্রম করেই রয়েছে একটি দোকর সোপান যা সরাসরি নিয়ে যায় গর্ভগৃহে , যেখানে ছিল একটি অবিশ্বাস্য সূর্য দেবতার মূর্তি । কোনারক মন্দিরের প্রস্তরখোদিত ভাস্কর্যগুলি দিব্য অনুভূতি দ্বারা মনকে ভরিয়ে তোলে । মন্দিরগাত্রে দেখা যায় বহুবিধ ভাস্কর্য , যা সর্প , জিরাফ, হাতি সহ বিভিন্ন জীবজন্তুদের ফুঁটিয়ে তুলেছে । মন্দিরের প্রবেশদ্বারে রয়েছে যুদ্ধহস্তীকে পেষনকারী ভঙ্গীতে অবস্থানরত দুটি সিংহ , যা বৌদ্ধ ধর্মের (হস্তী) ওপর ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের (সিংহ) আধিপত্যকে চিহ্নিত করছে । এই হস্তী দুটি আবার পালাক্রমে দুটি মানবশরীরের উপর শায়িত । কোনারকের মন্দিরটি সূর্য দেবতার মহিমাময় গতিবিধিকে নির্দেশিত করে । মন্দিরের প্রবেশদ্বারের সামনে রয়েছে একটি নাট মন্দির , যেখানে মন্দিরের নর্তকীরা সূর্য দেবতার উদ্দেশ্যে সশ্রদ্ধ নৃত্য পরিবেশন করতো । মন্দিরের চতুর্দিকের দেওয়ালগাত্রে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও জ্যামিতিক নকশা খোদিত আছে । বিভিন্ন ধরনের মানবিক, স্বর্গীয় ও আধা–স্বর্গীয় ইন্দ্রিয়–উদ্দীপক নকশা ও মূর্তি দ্বারা মন্দিরের দেওয়ালগুলিকে সুসজ্জিত করা হয়েছে । কামদ ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে কোনার্কের সূর্য মন্দিরের জুরি মেলা ভার । বাৎস্যায়নের কামসুত্র থেকে উদ্ভূত দম্পতিদের প্রনয়শীল বহু মূর্তিও এখানে উৎকীর্ণ রয়েছে । মন্দিরের বহু অংশ আজ ভগ্নাবশেষের আকারে দাঁড়িয়ে আছে এবং মন্দিরের বহু ভাস্কর্যকে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পরিচালনাধীন সান টেম্পল মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মন্দির সম্পর্কে বলেছিলেন : “এখানে পাথরের ভাষা মানুষের ভাষাকে অতিক্রম করে গেছে ” । এই মন্দিরের ধারণা ছিল মহীয়ান । মন্দিরটি ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান চিত্তাকর্ষক সৌধ , যা তার মনোরম মাত্রা ও আকৃতির জন্য প্রসিদ্ধ । মন্দিরটিতে অনুপম স্থাপত্যশৈলী ও জীবন্ত ভাস্কর্যশৈলীর এক অভূতপূর্ব সমন্বয় পরিলক্ষিত হয় । কোনারক মন্দিরের ভাস্কর্যগুলো তাদের সৌন্দর্য ও লাবণ্যের জন্য শিল্প দুনিয়ায় প্রসিদ্ধ ।



কোনার্ক মন্দিরের কামদ ভাস্কর্যের কিছু চিত্র
মন্দিরগাত্রের প্রতিটি ইঞ্চি বৃহৎ ও ক্ষুদ্রকায় পৌরাণিক কাহিনীর ভাস্কর্য এবং স্বতন্ত্র ভাস্কর্য দ্বারা অলংকৃত । মন্দিরের হাজার হাজার ভাস্কর্যের বিষয়বস্তু হল দেবদেবী ,ঐশ্বরিক ও মানবিক সংগীতকার, নর্তকী , প্রণয়ী , রাজকীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন শিকার , যুদ্ধযাত্রা , রাজসভার বিনোদন ইত্যাদি। অনেক ভাস্কর্যের মধ্যে বহুবিধ পাখি , জীবজন্তু , পৌরাণিক জীব , উদ্ভিজ এবং জ্যামিতিক আলংকারিক নকশা প্রতিফলিত হয় । মুখ্য মন্দিরের ভূমিদেশে প্রায় দু‘হাজার মনোহর ও জীবন্ত হস্তী–ভাস্কর্য উৎকীর্ণ রয়েছে । সমগ্র মন্দির জুরেই প্রখ্যাত রত্নরূপী ওড়িশান শিল্পকলার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবং এক বিশ্বস্ত মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গি কোনারক সূর্য মন্দিরের ভাস্কর্যগুলিকে অত্যন্ত সুবোধ্য করে তুলেছে। মূলত দেউরি বা বারান্দা অংশের দ্বিতীয় স্তরে দৃশ্যমান প্রেমমূলক ভাস্কর্যগুলোর জন্য এই মন্দির খ্যাতি অর্জন করেছে । একজন দর্শক খুব সহজেই এখানকার শিল্পকর্মের বিষয়বস্তুর উন্মুক্ত চরিত্র , কোমলতা , আবেগময় আন্দোলন উপলব্ধি করতে পারবেন । জীবনের এই মানবিক ও অসংযত দৃষ্টিভঙ্গি কোনারক মন্দিরের প্রায় সকল ভাস্কর্যে প্রতিফলিত হয়েছে , যেখানে হাজার হাজার মানুষ, জীবজন্তু এবং স্বর্গীয় চরিত্র মর্মস্পর্শী বাস্তবের চেতনা নিয়ে জীবনের আনন্দমেলায় সামিল হয়েছে । এই বৃহৎ ও অনুপম স্থাপত্যশৈলী এবং সূক্ষ্ম ও জীবন্ত ভাস্কর্যশৈলী অন্যান্য মন্দিরের কাছে কোনারক মন্দিরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে ।



কোনার্ক মন্দিরের ভাস্কর্য শিল্পের কিছু চিত্র
কোনার্ক সূর্যমন্দিরের অবনতি :
বহু ঐতিহাসিক অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে , কোনারক মন্দিরের নির্মাতা রাজা লাঙ্গুল নরসিংহদেবের অকাল মৃত্যুর জন্য মন্দিরটির নির্মানকার্যে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয় । ফলস্বরূপ মন্দিরের অসম্পূর্ণ কাঠামোটি অবশেষে ভেঙে পড়ে । কিন্তু এই অভিমতের স্বপক্ষে কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়নি । পুরী জগন্নাথ মন্দিরের মাদল পঞ্জী এবং ১৩৮৪ সালের কেন্দুলি তাম্রপট্ট অনুসারে রাজা নরসিংহদেব শাসন করেছিলেন ১২৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । অনেক ঐতিহাসিকের অভিমত হল যে , কোনারক মন্দিরের নির্মানকার্য সমাপ্ত হয়েছিল ১২৫৩–৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে । কাজেই অসম্পূর্ণ নির্মানকার্যের কারনে
মন্দিরের পতনের অভিমতটি গ্রহনযোগ্য নয় ।
কোনারকের সূর্য মন্দিরটি কখনো পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি – এ ব্যাপারে একমত প্রায় সবাই । তথাপি মন্দিরটি পুরো অক্ষত নেই । বিভিন্ন সময়ে মন্দিরের বিভিন্ন অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে । সেগুলো নিয়ে রয়েছে নানান মুখরোচক গল্প , যা যুগে যুগে এই মন্দিরের পুরোহিতদের মুখে মুখে চলে আসছে । গল্পটি হল একটি শক্তিশালী চুম্বকের । বলা হয় , সূর্য মন্দিরের ঠিক মাথায় ছিল একটি অত্যাধিক শক্তিশালী এবং বড় চুম্বক । এর চারপাশের দেয়ালে ছিল তুলনামূলকভাবে কম শক্তির চুম্বক । ফলে কেন্দ্রের চুম্বকটির আকর্ষণে পুরো মন্দিরের কাঠামো ভারসাম্যপূর্ণ থাকতো । কিন্তু সমস্যা বাঁধে মন্দিরের অদূরে চন্দ্রভাগা নদীতে জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে । এ চুম্বক এত শক্তিশালী ছিল যে এর কারণে নদীতে যাতায়াতকারী বানিজ্যিক জাহাজগুলোর কম্পাস দিক নির্ণয়ে ভুল করতো , বহুক্ষেত্রে ভুল পথে গিয়ে অনেক জাহাজ ডুবে যেত । এই কারণে মুসলিম বণিকেরা (আফগান নাকি পার্সি এমন কোনো পরিচয় নেই )একবার কোনারকে জাহাজ ভিড়িয়ে ছিনিয়ে নেয় মন্দিরের মাথার বড় চুম্বকটি । আর তাতেই ভারসাম্য হারিয়ে ধ্বসে পড়ে মন্দিরটি । কিন্তু এই গল্পের স্বপক্ষে কোনো ঐতিহাসিক তথ্য আজও পাওয়া যায়নি ।
কোনারক সূর্যমন্দিরের পতন বিষয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ত্ব হল কালাপাহাড়ের আক্রমণ সম্পর্কিত মতবাদ । উড়িষ্যার ইতিহাস অনুসারে , গৌড়ের শাসক সুলেমান খান কররানীর সেনাপতি কালাপাহাড় ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যা আক্রমণ করে । কোনারক মন্দির সহ উড়িষ্যার বেশ কিছু হিন্দু মন্দির তিনি ধ্বংস করেছিলেন । পুরী জগন্নাথ মন্দিরের মাদল পঞ্জী ব্যাখ্যা করেছে যে কীভাবে কালাপাহাড় উড়িষ্যা আক্রমণ করেছিলেন । কোনারক মন্দির সহ বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরের মূর্তিগুলো কালাপাহাড় বিনষ্ট করেছিলেন । যদিও ২০ থেকে ২৫ ফুট পুরু কোনারক মন্দিরের প্রাচীরগুলিকে ধ্বংস করা অসম্ভব , কিন্তু কালাপাহাড় মন্দিরের দধিনৌটি বা খিলান–প্রস্তরটিকে স্থানচ্যুত করে মন্দিরের কাঠামোটি দুর্বল করে দেয়। ফলে ধীরে ধীরে মন্দিরটির পতন ঘটে এবং মন্দিরের উপরের অংশ থেকে প্রস্তর বর্ষনের ফলে মুখশালার ছাদটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয় । মন্দিরের বহু মূর্তি এবং পার্শ্ব মন্দিরগুলিকেও কালাপাহাড় বিনষ্ট করেছিলো ।
এরপর কালক্রমে ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যার ওপর মুসলিম নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয় , ফলস্বরূপ হিন্দু মন্দিরগুলির ওপর বারংবার আক্রমণ ঘটতে থাকে । পুরী মন্দিরের পবিত্রতা রক্ষার জন্য পুরীর পান্ডারা জগন্নাথ দেবের মূর্তিটি শ্রীমন্দির থেকে সরিয়ে ফেলে এবং একটি গুপ্ত স্থানে লুকিয়ে রাখে । একই ভাবে কোনারক মন্দিরের পান্ডারাও মন্দিরের অধিষ্ঠাতা দেবতার মূর্তিটি সেখান থেকে সরিয়ে বহু বছর ধরে বালির নিচে লুকিয়ে রাখে । সূত্র থেকে জানা যায় যে , পড়ে সেই মূর্তিটি পুরীতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং জগন্নাথ মন্দিরের প্রাঙ্গণে ইন্দ্র মন্দিরে সেটি রাখা হয় । অনেক পন্ডিত মনে করেন যে কোনারক মন্দিরের মূল অধিষ্ঠাতা দেবতার মূর্তিটি এখনও উদ্ধার করা যায়নি । আবার অনেকে মনে করেন যে বর্তমানে দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রাখা সূর্য দেবতার মূর্তিটিই হল কোনারক মন্দিরের মূল অধিষ্ঠাতা মূর্তি ।

কোনার্ক মন্দিরে প্রাপ্ত সূর্য দেবতার মূর্তি যা বর্তমানে রয়েছে দিল্লির জাতীয় জাদুঘরে
মন্দির থেকে অধিষ্ঠাতা দেবতার মূর্তিটি সরিয়ে ফেলার পর থেকে সেখানে সূর্য দেবতার উপাসনা ও তীর্থযাত্রা বন্ধ হয়ে যায় । জলদস্যুদের আক্রমণের জন্য কোনার্ক বন্দরটিও বন্ধ হয়ে যায় । সূর্য উপাসনার জন্য বিখ্যাত কোনার্ক বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রেও খ্যাতি অর্জন করেছিল । কিন্তু যেদিন থেকে সূর্য মন্দির পুন্যার্থীদের আকৃষ্ট করা বন্ধ করে , তার পর থেকেই কোনার্ক জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং বহু বছর ধরে গভীর অরণ্যের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায় ।

১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে খুরদার রাজা নরসিংহদেব (পুরুষোত্তম দেবের পুত্র ) ঋতি দেবতা চন্দ্র ও সূর্যের মূর্তি সহ মূল সূর্য দেবতার মূর্তিটি পুরীতে নিয়ে যায় । পুরী জগন্নাথ মন্দিরের প্রাঙ্গণে একটি দেবালয়ে বর্তমানে তারা উপস্থিত । পুরী মন্দিরের মাদল পঞ্জীতে লিপিবদ্ধ আছে যে , ১০২৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরসিংহদেবের নির্দেশে কোনার্কের সমস্ত মন্দিরের পরিমাপ করা হয় । এই পরিমাপের সময় আমলক শিলা পর্যন্ত সূর্য মন্দিরের উচ্চতা ছিল ২০০ ফুট । কালাপাহাড় শুধুমাত্র মন্দিরের কলস , চূড়া–প্রস্তর এবং পদ্মধ্বজ সহ উপরের অংশটি বিনষ্ট করেছিলো । ” নবগ্রহ পাত ” নামে একটি বিশালাকার পাথরের ফলক সূর্য মন্দিরের মুখশালায় স্থাপন করা হয়েছিল । খুরদার রাজা সেই ফলক সহ মন্দিরের বহু মূর্তি সেখান থেকে অপসারিত করেন এবং সেগুলো দিয়ে পুরী মন্দিরের বেশকিছু অংশ নির্মাণ করেন । এরপর অষ্টাদশ শতাব্দীতে মারাঠা শাসনকালে কোনারক সূর্য মন্দির থেকে আনা পাথর দিয়ে পুরী মন্দিরের বহিঃপ্রাঙ্গনের প্রাচীর নির্মাণ করা হয় ।১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে গোঁসাই নামক এক মারাঠা সাধু কোনারক মন্দিরের অরুন স্তম্ভটি তুলে নিয়ে যায় এবং পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদ্বারের সামনে সেটি স্থাপন করে । এইভাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে কোনারক তার গরিমা হারিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত বালুকারাশি ও গভীর অরণ্যের মধ্যে নিমজ্জিত হয়।

কোনার্ক সূর্য মন্দিরের অরুণ স্তম্ভ, যা বর্তমানে দেখা যায় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সম্মুখ ভাগে
কোনারক মন্দির বিষয়ক কিংবদন্তি বা লোককাহিনী :
কিংবদন্তি অনুসারে গাঙ্গ বংশীয় রাজা প্রথম নরসিংহদেব তাঁর রাজবংশের রাজনৈতিক আধিপত্যের রাজকীয় ঘোষণা হিসেবে সূর্য মন্দিরটি নির্মাণ করার আদেশ দিয়েছিলেন । ১২০০ জন শিল্পী , কারিগর ও স্থাপত্যশিল্পীর একটি দল ১২ বছর ধরে তাদের সৃজনশীলতা , কর্মশক্তি এবং শৈল্পিক প্রতিশ্রুতি বিনিয়োগ করে । মন্দিরটি নির্মাণ করতে রাজা নরসিংহদেব তাঁর রাজ্যের প্রায় ১২ বছরের রাজস্ব ব্যয় করেছিলেন , তবুও মন্দিরের নির্মাণকার্য কবে সমাপ্ত হবে তা অনুমান করা সম্ভব হচ্ছিল না । রাজা নরসিংহদেব একটি নির্দিষ্ট দিনে নির্মাণকাজ সমাপ্তির হুকুম জারি করেন । স্থাপত্যশিল্পী গোষ্ঠী , যাদের প্রধান ছিলেন বিসু মহারানা , তারা নির্মাণকার্য সমাপ্তির আশা ছেড়ে দেন । এরপর প্রধান কারিগর বিসু মহারানার ১২ বছর বয়সী পুত্র ধর্মপদ একজন পরিদর্শক হিসেবে মন্দিরের নির্মাণস্থলে উপস্থিত হয় । ধর্মপদ বুঝতে পারেন যে একপ্রকার হতাশা শিল্পী–কারিগরদের গ্রাস করেছে । যদিও মন্দির নির্মাণের অভিজ্ঞতা ধর্মপাদের ছিল না তবে মন্দির স্থাপত্যশৈলীর তত্ত্ব সে অনুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন করেছিলো । সে প্রস্তাব দেয় যে মন্দিরের শিখরের শীর্ষদেশে কলস বা মঙ্গলঘটটি সে স্থাপন করবে এবং এই বিভ্রান্তিকর কাজটি সম্পন্ন করে ধর্মপদ সকলকে বিস্মিত করে দেয় । কিন্তু যেহেতু রাজার নির্দেশ ছিল ১২০০ শ্রমিক দিয়েই মন্দিরটির নির্মাণ সম্পন্ন করতে হবে আর মঙ্গলঘটটি বসান প্রধান বাস্তকারের পুত্র ধর্মপদ , সুতরাং শ্রমিকের সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় ১২০১ । কাজেই রাজার আদেশ অমান্য হওয়ায় রাজা যদি শ্রমিকদের মৃত্যুদণ্ড দেন , তাই অন্যান্য শ্রমিকদের প্রান বাঁচাতে ধর্মপদ মন্দিরের শিখর থেকে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল । ফলে মন্দিরটির পবিত্রতা নাশ হওয়ায় এই মন্দিরে নাকি কোনো দেবতার পূজো করা হয়নি ।
কোনারক মন্দিরের নির্মাণের পেছনে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণপুর কারবারের আরেকটি দারুন কাহিনী । পুরাণ মতে , শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্ব রূপে অত্যন্ত নয়নভোলানো ছিলেন । সব মহিলাদের নজর কাড়তেন । শাম্ব একদিন নারদের ডাকে সাড়া দিতে ভুলে গেলে নারদের মনে প্রতিশোধস্পৃহা জাগে । একদিন কৃষ্ণ যখন গোপিনীদের সঙ্গে লীলায় ব্যস্ত , তখন নারদের মন্ত্রনায় শাম্ব সেখানে ঢুকে পড়ে। সেই সময় গোপিনীদের নজর তার ওপর গিয়ে পড়ে । তখন কৃষ্ণ রেগে গিয়ে শাম্বকে অভিশাপ দেন যে তার রূপ হারিয়ে যাবে । শাম্ব কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন । কোনো বৈদ্যই তার এই কুষ্ঠ রোগ সারাতে সক্ষম হননি । এরপর শাম্ব চন্দ্রভাগা নদীর তীরে বসে টানা ১২ বছর একভাবে তপস্যা করেছিলেন । অবশেষে তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে সূর্যদেব তার কুষ্ঠরোগ চিরতরে সারিয়ে দিয়েছিলেন । সূর্য দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্যেশ্যে শাম্ব তখন একটি সূর্য মন্দির নির্মাণের অঙ্গীকার করেন । এর পরের দিন শাম্ব যখন নদীতে স্নান করছিলেন , তখন তিনি নদীতে সূর্য দেবতার একটি মূর্তি পান । অতঃপর তিনি সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করে মূর্তিটিকে সেখানে স্থাপন করেন । মন্দির নির্মাণের শত শত বছর পরেও বহু ভাঙা–গড়ার মধ্য দিয়ে আজও কোনারক মন্দির উড়িষ্যার বুকে দীপ্তি ছড়াচ্ছে , যেন সূর্য দেবতা নিজেই তাঁর স্বর্গীয় রশ্মি বিকীর্ণ করছে ।
উপসংহার:
জগন্নাথ মন্দিরের বিশেষত্ব তার বিশালতায় আর কোনারক সূর্য মন্দিরের বিশেষত্ব হল যে ভাস্কর্য এখানে যেন স্থাপত্যের সঙ্গে এক হয়ে মিশে যেতে চেয়েছে । হুনুরির শক্তির কাছে হার মেনে কঠিন পাথরও যেন হয়ে পড়েছে ফুলের মতো কোমল ! শ্রীমতী স্টেলা ক্র্যামরিস বলেছেন যে উড়িষ্যায় স্থাপত্য বলতে বোঝায় বিশাল আকারে ভাস্কর্য ! স্বর্গীয় কুমারস্বামী বলেছেন , কোনারক ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও ভাস্কর্যের পারে স্থাপত্যের এমন অঙ্গাঙ্গি যোগ দেখা যায় কিনা সন্দেহ । মন্দিরের কাঠামোর ভিতর থেকে মূর্তিগুলিকে কোথায় বিচ্ছিন্ন করা চলে না ।
কোনারকের পরিকল্পক নিশ্চয়ই ছিলেন কবিমনের অধিকারী । মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এমন জায়গায় , যেখানে অসীম সমূদ্র তার বিপুল তরঙ্গবাহু তুলে অহরহ ঝাঁপিয়ে পড়ে , আর ঝাঁপিয়ে পড়ে নতি নিবেদন করতে আসত সূর্য দেবতার চরণে । কিন্তু পরিকল্পকের সেই ভাবপ্রবণতা উপভোগ্য হলেও মন্দিরের পক্ষে শুভ হয়নি । মহাসাগরের গভীর উচ্ছাসই হয়েছিল অকালে মন্দিরের পতনের কারণ । এখন নিরালায় পড়ে থাকে মন্দিরের ভগ্নাবশেষ । সূর্যদেবতা নির্বাসিত । আজও রোজ সূর্য ওঠে , কিন্তু দেউলের ভিতরে আর খুঁজে পায় না নিজের প্রতিমা । আজও দূর থেকে ভেসে আসে মহাসাগরের স্তোত্রপাঠ ! কিন্ত দেবতার বেদীর সামনে আজ আর জ্বলে না পূজোর প্রদীপ ।
১৯৩০ সালের দিকে কোনার্ক সূর্যমন্দিরের আংশিক পুনর্নির্মাণের কাজ হয় । সংস্কার করা হয় এর বেশকিছু ভাঙা অংশের । ভারত স্বাধীন হবার পর থেকেই ভারতের পর্যটকদের জন্য এই মন্দির একটি বড়ো আকর্ষণ । পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো যখন কোনার্ক সূর্যমন্দিরকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় , তখন থেকে বিদেশি পর্যটকদের ভিড়ও বাড়তে থাকে এখানে । বিশেষ করে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে পর্যটকদের ঢল নামে । কারন ফেব্রুয়ারিতে এখানে অনুষ্ঠিত হয় বাৎসরিক চন্দ্রভাগা মেলা , যা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি বিশেষ ধর্মীয় উৎসব । সুদীর্ঘ ৮০০ বছরের ইতিহাস–ঐতিহ্যের ধারক এই মন্দিরের আধ্যাত্মিকতার টানে প্রতিদিন এখানে ছুটে আসে শত শত ধর্মপ্রাণ মানুষও , যাদের কাছে এটি একটি তীর্থস্থান । ধর্ম , আধ্যাত্মিকতা , প্রত্নতত্ত্ব , প্রাচীনত্ব আর নির্মাণশৈলী — সব মিলিয়ে কোনার্কের সূর্যমন্দির অনন্য অসাধারণ ।
গ্রন্থপঞ্জী :
1. Dey , Anil . The Sun Temple Of Konark . Niyogi Books Publishers. 2. Agarwal, Vikas . The Konark Sun Temple . Notion Press ,2019 .
3. Brown , Percy . Indian Architecture , Buddhist And Hindu . CBS Publishers And Distributors , 2014
সুমিত বণিক
প্রাক্তন বিদ্যার্থী
ইতিহাস বিভাগ
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়