
দুর্নীতির আঁধারে সমাজ : একটি সমীক্ষা - বারিদবরণ গুপ্ত
আজকাল দুর্নীতি কথাটা আমাদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, অফিসে আদালতে বাসে ট্রামে ট্রেনে মাঠে-ঘাটে যত প্রকারের আলোচনা হয় তার মধ্যে অবশ্যই দুর্নীতির কথাটা উঠে আসবেই। সাধারণ ভাবে বলা যায় নিয়ম-নীতিহীন কাজই হলো দুর্নীতি, এককথায় দুর্নীতি হলো এক ধরনের বিচ্যূত আচরণ, এই আচরণ সামাজিক ন্যায়-নীতি সততা মানবিকতকে লংঘন করে, সমাজবজ্ঞানীরা দুর্নীতিকে সামাজিক ব্যাধি বলে বর্ণনা করেছেন, এ বিষয়ে সকলেই সহমত পোষণ করেন যে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি সমাজ কম বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত, তবে এশিয়া তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই বিচ্যুত আচরণ লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে।
দুর্নীতিকে আমরা তিনটি স্তরে ফেলে বিশ্লেষণ করতে পারি, সাধারণত সমাজের ক্ষমতাসীন বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতি, এ ধরনের দুর্নীতি সমাজের নামিদামি লোকেরা করে থাকেন, তারা অর্থ বা ক্ষমতার জোরে দুর্নীতি করার সাহস পায়, এই স্তরে সমাজের প্রভাবশালী রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের ফেলা যেতে পারি, দ্বিতীয় স্তরে সাধারণত সরকারি আমলা, কর্মচারী, যারা সরকারি ক্ষমতার সাহায্যে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, আর তৃতীয় স্তর হল সমাজের সাধারণ মানুষ বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীবৃন্দ । এক কথায় গোটা সমাজ কম বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত ।
এখন সবার মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে দুর্নীতিকে কেন রাখা যাচ্ছে না, কেন সমাজ দুর্নীতির আঁধারে ডুবে যাচ্ছে, তাহলে কি সমাজ থেকে ন্যায়-নীতি মূল্যবোধ বিলুপ্ত হয়ে গেছে? আসলে সমাজ হলো নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিষ্ঠান, সমাজের নিয়ন্ত্রক গুলো যেমন আইন বিচার ও শাস্তি ,তিরস্কার ,প্রতিরোধ , প্রতিবাদ ইত্যাদি আলগা হয়ে গেলে তখনই সমাজ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেকেই দুর্নীতিকে পুকুরের কচুরিপানা বাড়ার সঙ্গে তুলনা করেন, যদি সূচনাতেই না নির্মূল করা যায় তাহলে যেমন সে গোটা পুকুর ছেয়ে ফেলে, দুর্নীতি ও ঠিক তাই, প্রাথমিক পর্যায়ে না রুখতে পারলে মহামারীর মত গোটা সমাজকে খেয়ে ফেলে ।
বর্তমানে বিশ্বসমাজ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, এই উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি দেশ দূর্নীতিতে একে অপরকে টেক্কা দিচ্ছে, বর্তমানে মানুষ রাতারাতি ধনী হতে চায়, একে অপরের থেকে আরও বেশি অর্থবান প্রতিপত্তিশালী হতে চায়, এছাড়াও বর্তমানে প্রচন্ড ভোগবাদী মানসিকতা দুর্নীতির অন্যতম কারণ বলে সমাজতাত্ত্বিক রা মনে করেন। বর্তমানে বিশ্বসমাজ সহজ পথে অল্প সময়ে অর্থ রোজগারের জন্য যে নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে তার জন্যই দুর্নীতি হু হু করে বাড়ছে ।
Tranperancy International নামক সংস্থা দুর্নীতি বিষয়ে সমীক্ষা করে, অতি সম্প্রতি তাদের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই কম বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত, এদের রিপোর্ট অনুযায়ী তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বর্তমানে দুর্নীতি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। টি আই এর রিপোর্ট অনুযায়ী এশিয়ার দেশগুলো দুর্নীতিতে একে অপরকে টেক্কা দিচ্ছে, বর্তমানে ভারত বিশ্বের দুর্নীতিগ্ৰস্থ দেশের মধ্যে ৭৮ তম স্থানে রয়েছে, একমাত্র ভুটান ছাড়া এশিয়ার সমস্ত দেশ গুলিই কম বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত । অতি সম্প্রতি ভারতে সরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে, তাতে সরকারি কর্মচারী থেকে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যুক্ত হয়ে পড়ছেন, সরকারি চাকরি থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষ-স্বজনপ্রীতি ইত্যাদির ঘটনা ঘটছে, বারবার আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে, আর সি বি আই তদন্তের তো আর শেষ নেই।
বর্তমানে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা । এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত শক্তির জাগরণ, দেশ ও সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, এ বিষয়ে নতুন প্রজন্মকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে, সমাজ রাষ্ট্রকে আরো বেশি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে, সমাজের বিধিবদ্ধ এবং অবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কে আরো বেশি শক্তিশালী করতে হবে, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে সমাজ একটি নিয়ন্ত্রণ মূলক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া সমাজ থেকে হারিয়ে যাওয়া ন্যায়- নীতি মূল্যবোধকে ফিরিয়ে আনতে হবে, তার জন্য মূল্যবোধ চর্চা বাড়াতে হবে, সর্বোপরি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে মানবিকতাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, তবেই বর্তমান সমাজের যে সংকট অর্থাৎ দুর্নীতি, সমাজতাত্ত্বিকরা যাকে সমাজের অসুখ বলেছেন, তা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো!
Bio :
বারিদবরণ গুপ্ত
বাড়ি পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের সাহাপুর গ্রামে, একজন শিক্ষাবিদ, কবি, প্রাবন্ধিক সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখালেখির সাথে যুক্ত, তাছাড়া লৌকিক সমাজ সাহিত্য বিষয়ক লেখালেখির সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত আছেন,
Tags: The Indian Rover