মন্দিরের ঈশ্বর - অভিজিৎ সাহা
সালটা ২০১৮, ওই বছরের প্রায় প্রথমলগ্নে ঘন শীতের পোশাকে এক অনুত্তীর্ণ অভিঞ্জতা আমার হয়েছিল। ভ্রমণের তীব্র তেষ্টা মেটাতে বেড়িয়ে পড়েছিলাম এক প্রত্যন্ত জেলাতে, বীরভূম। প্রায় চার রাত্রি অতিবাহিত করেছিলাম সেখানে।
প্রকৃতি-পরিবেশের যে অসম্ভব উজ্জলতা মনে হয় সেখানেই গেলে ধরা পড়ে যায়। ধরতে পারা যায় হাতের নাগালে। মন চাইনি সেখান হতে ফিরে আসতে ,শুধু মনে হয়েছিল জন্ম-জন্মান্তর এখানে বাঁসা বেঁধে রই। সবকিছুকে কেমন অনাবৃত, উজার করে ফেলে রেখেছে চাদরের মতন করে তাদের ওই প্রকৃতি মা- কি রিক্ত, দৃঢ়তা আর শৃঙ্খলের সাথে।
জনসংখ্যা নেহাতই কম কিন্তু সেখানে মনুষ্যের দৌড়াদুউড়ি বেশ ছটফটে লাগছিল। তবে বেশিরভাগ দিনআনা সাধু-সন্ন্যাসী, ভিক্ষাবৃত্ত- অভুক্ত দেখতে পেলাম বেশ জায়গায় মানে রাস্তার ফুটপাতে। তাদের সৌম্যদীপ্ত আকুতি যেন অন্য আরেক মানুষের হৃদয়ে দগ্ধতার পরিচয়ে ভাসিয়ে তোলে।
ফিরে আসার ঠিক গত দিন পূর্বে শৈতপ্রবাহে র স্নিগ্ধায় রওনা হলাম এক মাত্রাহীন প্রভাত গন্ধের খোঁজ নিতে। সেদিন গাড়ি থেকে নেমেই মত্তর’ আমরা কয়েকবন্ধু মিলে ওই গ্রামের নির্মম প্রকৃতির প্রেমিক সাজতে গেছিলাম। বেশ অদূরে, একেবারে লালমাটির প্রান্ত বললেই ভুল নেহাত হবে না। রাঙামাটি, ওই যে দূরের গ্রামের সাথে মিশেছে। সেই পুরানো ছবি মনে করিয়ে দেয় আমাকে, আমাদেরকে -গ্রামের সেই সাদা কালো চেহারার সৌন্দর্যে যে অপরুপ সাজ লুকিয়ে থাকত তা আর বলিবার ভাষা নাই; -যেখানে ছিল গাভী ভর্তি গোয়ালঘর আর পাশে বসে থাকা গাভীর মাতা খড়ের চুনাত চুনাত আওয়াজের সাথে লড়ছে। একমনে, তাঁর ধৈর্য্য অনায়াসে পার করছে। কি বিচিত্র রুপ। কেউ আবার মাথা পূর্ণ শুকনো বৃক্ষের ডাল, খড়ের আঁটি ,গাছ-গাছালির পাতা বহন করিয়া নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে পথ নিয়েছে। বাঁশের বেড়া সাজানো ঘর কোথাও দেখলাম ভেজা মাটি আর খড়েরচাল দিয়ে আলতো বাঁধানো আবাস। যেন এক ঝড়ে পড়ে যেতে চাই সে। কিন্তু রয়ে গেছে কয়েক যুগকে পিছনে ফেলে।…
লোক সমাজ বেশ হারে কম ফলে যানবহনের সংখ্যাও সীমিত, যাত্রীবাহী কয়েকটা বাস আর হাতেগনা পা ভ্যান; তাই এখানে দূষণের পরিমাণও যথেষ্ঠ অল্প, ফলে প্রকৃতি বেশ সবুজে সবুজে উঁকি দিয়ে যায় সেটা বোঝা যায়। ঠিক তখনি ই মনে হয়েছিল আমি, আমরা যদি এ আলোক রম্ভা প্রকৃতির বাসিন্দা হতাম। যদি হতাম মেঘের হাতছানি, প্রতিটা বিকাল যদি এমন মুগ্ধ বাতাসের গভীরতায় শরীল ভাসাতাম ওফঃ কি যে তখন ভালো লাগত, যা যা অনুভূতি পেতাম সবটা লুকিয়ে রাখতাম, একেবারে মনের সতেজ কোঠাগারে।
কোকিলের বীনা বাঁশির সুর, কাঠবিড়ালীর ছুটন্ত গতি, প্রতিটা পাতার ঝলমলে চেহারা,ক্ষীণ উষ্ণ বাদাবনের হলুদ সূর্যমুখী, কৃষ্ণচূড়ার মনবৃত্ত রুপ সব যেন কেড়ে নিয়েছে প্রকৃতির থেকে। কি অপরুপ সবকিছু। এখানেই যেন মিশে গেছে সমস্ত অগুন্তি নির্মলের ভাবার্থ নিয়ে। প্রকৃতি , পরিবেশের সারমর্ম এখানেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তা দেখলে বেশ বোঝা যায়।
এমন মনভাসানো, খেয়া সাজানো দৃশ্য দেখে কোনভাবেই ওখান দিয়ে আসতে মন চাইছিল না তবুও ফিরতে হল গন্তব্যে; ঠাকুরবাড়িতে, কলেশ্বর।
প্রবেশ করলাম যথারীতি। প্রথমেই দেখলাম মা- ঠাকুমারা যে যার প্রার্থনা, সংকল্প, পূজা-আরতি নিয়ে গভীর ধৈর্য্যে আছেন মনে হল ঈশ্বর এখুনি ই তাদের সন্মুখে দেখা দিতে আসবেন। তাঁদের ভিন্ন আকুতি তা ভাবিয়ে দেয়। তারপর আমি কিছুটা হাঁটলাম,… বাকি বন্ধুরা দেখলাম দেবতার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেল। আমাকে নিয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু আমি অমত দেখালাম। তাই বাইরে থেকে ঠাকুরবাড়ির সৌন্দর্য নিজের হৃদয়ে বেশ সজোড়ে আহুতি করলাম।
ইশ্বর যেখানে বাস করেন সেই জায়গা কত পবিত্র, কত হৃদয়ে মিশে মনে হয় শান্তির সৌধে বাস করছি বর্তমান নিয়ে আমরা। এত শোর্য , এত মনকে স্নিগ্ধ- শুদ্ধ করে তোলে তা সত্যিই আনন্দের অভিধানে স্বয়ং। মন্দিরের চারিপাশ যেন সবুজের অত্যাচারে টইটুম্বুর। কি অসম্ভব ছবি ফুটে উঠেছে তা না দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হবে। শান্ত , নিরিবিলি এক স্থান। মানুষের ব্যবহার আর কথা বেশ সংযোমী। নূতন মানুষের সমাগম দেখলে ওঁনারা কথা বলতে ভালোবাসে তাও বুঝলাম।
মানুষ কম তাই প্রকৃতির ওপর জোড়-জবস্তি লড়াই হয় না, বিপন্ন হতে হয় না। ভাঙ্গন নেই। যেটুকু আছে তা মানুষ অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি।
মন্দির চত্তরে আবার বেশ কিছুটা চললাম, প্রকৃতির রঙে মাঝি হতে; সামনে দেখিলাম এক মোটা অশত্থ বৃক্ষের তলে বসে আছে জনা পাঁচেক পা দুলুনি শিশু তবে তাদের কথাবার্তা ও শৃঙ্খলা শুনে নাবালিকা বললেও নেহাত ভুল হবে না। তারা যেন একে ওপরের পাশে বসে কি এক গল্প করছে, আর খুব হাসি হাঁসছে। মনে হল এর আগে ওত হাসি হাঁসেনি ওই ফুটন্ত সুন্দরীরা।
আমি তো আর থাকতে পারলাম না ওদের সাথে গল্পে মিশে গেলাম। আমি বললাম তোমাদের গল্পে আমাকে নিতে হবে যে, ওরা হাঁসলো সবাই, আর তাদের মধ্যে কোন এক চম্পা বলে উঠলো কেন আমরা তোমাই নেব? তুমি তো অচেনা! আমি বললাম চেনা হতে অসুবিধা হবে কোথায়? ওরা আবার হাঁসছে। জিঞ্জাসা করলাম তোমাদের নাম কি? ওরা একে একে নাম বলে দিল; আবার চম্পারা(শিশুরা) আমার নাম ও জানতে চাইলো, আমি ও বললাম। তারপর কচি মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম তোমরা পড়াশুনা করছো? ওরা উত্তরে বললো হুম করছি তো। আমি বললাম কোন ক্লাস,- আমরা দুজন ফাইভে, ও ফোর-এ আর ওরা দুজনে সিক্সে। আমি বললাম বাবাআ! তোমরা কতদূর পর্যন্ত পড়াশুনা করেছ আমি বাপু ওতো দূরে যেতেই পারিনি! ওরা এই মিথ্যেটা বুঝতে পেরে খুব হাসি হাঁসছিল। যাক্ আমিও ওই মেঘবালিকাদের সাথে অন্তরঙ্গ হৃদয়ে প্রেমের অত্যাচারে মিশে গেলাম।
সেদিন বারে শুক্রবার ছিল, তাই আমি বললাম স্কুলে যাওনি কেন তোমরা ? ওরা এবার লুকিয়ে লুকিয়ে অভুক্তের জ্বালা অনুধাবন করতে লাগলো। মৃদু হাসি হাঁসলো তবুও আমার প্রশ্নের জবাব এলো না। আমি আর তেমন করে কিছূ বলিনি। বন্ধুদের ডাকাতেই আমি ওমন চাঁদের হাট থেকে বিরতি নিলাম। …
খানিক পরে চম্পাদের একে ওপরের ভালোবাসা আর দেখতে পায়নি! ঠাকুরবাড়িতে আমাদের এক ম্যাডাম ভক্তদের তরে ভোজনের আয়োজন করেছিল সেদিন। তাই পরিবেশনে দেওয়া নেওয়া করতে এগিয়ে গেলাম। কত শত ভক্ত, অভুক্ত, উপবাসে থাকা মানুষের ভীড়ে যেন ঠাসাঠাসি; উৎসব চলছে, মানুষের মুখে মুখে সবাই বলছে আজ ঠাকুরবাড়ির মহৎসব চলছে। আজ আমাদের ভালো দিন। একে একে থালা, বাটি নিয়ে আসছে বাড়ির বাকী লোকের মজুতের জন্যে কিংবা অভুক্ত রাত টাকে কোনোভাবে চালানোর জন্য।
শালপাতার মোড়কে ফ্রায়েড রাইসের সুবাস পেতে পেতে আমার ক্ষুধার্তের মোহ বরং বেড়েই গেল। দিয়েই চলেছি একের পর এক, তারপর যা দেখলাম তা নিজের চোখকে ও বিশ্বাস দিতে পারিনি। দেখলাম সেই বৃক্ষের পা দুলানি চম্পারা পাশাপাশি বসে রয়েছে আমাকে দেখে খুব লজ্জায় পেতে হল। আমি তো ওদের দেখা দিতে চাইনি তবুও কিভাবে আবার দেখা পেলাম! ঈশ্বর রক্ষা করো আমায়।
তারপর হাতের থেকে রাইসের বালতি টা রেখে নিরালায় আশ্রয় নিলাম। একাকী! সেদিন আর চোখের জল কে সামলাতে পারিনি। হৃদয়ের পোড়া তেজস্রী কে বোঝাতেও পারিনি। কি দেখলাম আমি!? ওই চম্পারা অভুক্তের জ্বালা মেটাতে গিয়ে স্কুলের গন্ডী দেখলো না আজ! ওফঃ কত কিছু শেখা হল না, কত বন্ধুর সঙ্গও পেলনা আহা রে , এই বেদনা কোথায় লুকাই? এতটাই ক্ষুধার্ত থাকতে হয় ওদেরকে। কেন এসব অবলীলা চলছে শত শত চম্পাদের সাথে; কেন হচ্ছে ওদের সাথে এসব? সেদিন কষ্ট করে আমিও ওদের থেকে লুকিয়ে গেছিলাম। ওদেরকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্যে। হায় রে শিশুমন!– একরক্তি অভুক্ত চম্পাদের পরিণতি এমনই অন্ধকারের ছিল, যা আমাদের চোখ কে সত্যিই দেখতে দেয় না!
বোঝা যায় না কোন বিপর্যয় গুলি বারে বারে সামনে আসতে থাকবে এবং কতগুলি নিরীহ সত্ত্বা অবিচারেই থেকে যাবে। স্বচ্ছ উত্তরের কাছে আশ্রিত থাকবো, অভুক্তের চম্পা সুন্দরীরা কিভাবে তাদের জীবনের স্বর্ণ, গোলাপি মুহূর্তগুলো অচিরেই শেষ করছে।।
— ”সুন্দর সুধাময় আলোতে আবার কোথাও যেন গরীবের গদি-তে,
যেখানে হৃদয়, অজস্র সহ্যের, যন্ত্রণার কদম ফুলিতে বাসা বেঁধে বয়….
সেটা কি গরীব কয়? হৃদয় তো ওখানেও রয়।” ……