
হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার আগমনী গান - তুষার ভট্টাচার্য
আকাশের নীলাম্বরী মেঘ ধোওয়া শরৎকাল এলেই শ্রুতিমধুর আগমনী গানের সুরে ভেসে যায় বাংলার বিস্তীর্ণ জনপদ, প্রান্তর l শারদীয়া দুর্গোৎসবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে আগমনী গান l
লোকশ্রুতি রয়েছে যে একদা রাজা সুরথ’ই নাকি প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন l তারপরে বিভিন্ন রাজা, জমিদাররা এই পুজোর পৃষ্ঠেপোষক ছিলেন l বর্তমানকালে দুর্গাপুজো সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে l চিরায়ত আগমনী গানও হয়ে উঠেছে
সর্বজনীন l
বিগত কয়েকদশক ধরে দুর্গাপুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে শারদীয়া পুজোর গান l প্রতিবছরই পুজোর সময়ে, দুর্গাপুজো নিয়ে নতুন গানের বিভিন্ন ক্যাসেট, সিডি বের হয় l
শরতের ঝকঝকে স্নিগ্ধ অরুণ আলোয় আকাশের নীল রঙে মিশে বহুদূর থেকে হয়তো বা মাইকে ভেসে আসে পুরোনো দিনের আগমনী গানের সুর l তখন মনটা মুহূর্তে হু -হু করে ওঠে প্রতিটি নস্টালজিক বাঙালির l কন্যাসমা উমা বা মা দুর্গার জন্য l
শরতের এই আগমনী গানের মধ্যে দিয়েই দেশমাতৃকার রূপের আবাহন করেছেন রবীন্দ্রনাথ l কবির কলমে অপরূপভাবে ফুটে উঠেছে –
” আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে ”
আবহমানকাল ধরে বাঙালির দুর্গাপুজো হচ্ছে মৃন্ময়ী মূর্তির মধ্যে দিয়ে দেবীর চিন্ময়ী হয়ে ওঠার আরাধনা, অর্থাৎ দেশমাতৃকার চিরন্তন পুজোর আরও একটি রূপ l যেখানে শারদ রাত্রির শিশির জলে ভেজা বাতাসে ভেসে আসে পবিত্রতার চন্দন সুবাস l
আপামর বাঙালির মানসরূপ থেকে দূর হয়ে যায় সমস্ত হিংসা, ক্লেদ, অন্ধকার l যখন বাংলার আগমনী গানে ভেসে ওঠে এই চিরায়ত সুর –
” শঙখে শঙখে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে
প্রণত বৎসলা তুমি পরম মঙ্গলা
পাদপদ্মে দেহস্থান সেবক বৎসলা ”
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন –
”এসো শারদলক্ষ্মী তোমার শুভ্র মেঘের রথে
এসো নির্মল নীলপদ্মে
এসো ধৌত শ্যামল আলোক ঝলমল
বনগিরি পর্বতে ”
এই শরতেই দেশকাল, প্রকৃতি ও দুর্গা পুজো সবকিছু মিলেমিশে এমন এক আবহের সৃষ্টি হয় এই বাংলায় যার তুলনা পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না l এই অপরূপ শারদ প্রাতের উল্লেখ করে কবি লিখেছেন –
”আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে
বাঁশি তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে
তোমার বুকে বাজল ধ্বনি
বিদায় গাঁথা আগমনী ”
কাল থেকে কালান্তরে, বছর থেকে বছরে, বাঙালিরা তাঁদের উত্তরসূরীদের হাতে এই শারদ প্রাতের বাঁশির সুরই দিয়ে যাচ্ছে আবহমানকাল ধরে l
মা দুর্গা অর্থাৎ, দেশ মাতৃকার উদ্দেশেই হয়তো কবি লিখেছিলেন এই গান –
”তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে
এসো গন্ধে বরণে এসো গানে ”
কিংবা,
লক্ষ্মী যখন আসবে তখন কোথায় দিবিরে ঠাই
দেখবে চেয়ে আপন পানে পদ্মটি নাই, পদ্মটি নাই ”
রবীন্দ্রনাথ মা দুর্গাকে অভিহিত করেছেন
শারদ সুন্দরী হিসেবে l
যেমন,
” কনক কিরণ ঘন শোভন স্যন্দন নামিছে শারদ সুন্দরী
দশ দিক অঙ্গনে দিগঙ্গ নাদল
ধ্বনিল শূন্যভরি শঙ্খ সুমঙ্গল
চলোরে চলো তুলি তব মালতি মঞ্জুরী ”
শরৎ এলেই এখনও বাংলার হাটে, মাঠে, ঘাটে মাইকে শুনতে পাওয়া যায় শচীন দেব বর্মনের সেই বিখ্যাত গান –
” তাক দুম তাক দুম
বাজে ভাঙা ঢোল
সব ভুলে যাই
ভুলি নাই
বাংলা মায়ের বোল
তাক দুম, তাক দুম ….”
বাংলা ভাষায় এইসব ছাড়াও রয়েছে আরও কত আগমনী গান l বাংলার লোক গানে, আধুনিক গানেও রয়েছে আগমনী গানের সুর l
প্রতি বছর দুর্গাপুজো এলেই আপামর বাঙালির হৃদয়ের তন্ত্রীতে গুনগুন করে বেজে ওঠে কত না গান l যেমন –
”শোন গো নিকট
এসো গো সুদূর
ঘরে ঘরে বাজে
আজ আনন্দ সুর ”
কিংবা,
”এই উজ্জ্বলতার স্রোতে
এই মঙ্গল গানে গানে
এই ফুটে ওঠা বিশ্বাসে
তুমি ফিরে এসো বারবার ”
মহালয়ার শিউলি ঝরা ভোরে যখন ‘ বাজল তোমার আলোর বেণু ‘ বা ‘ অয়ি ভুবনমোহিনী ‘গান শোনা যায় তখন সত্যিই মনে হয় কন্যা উমা আসছেন বছরপরে বাঙালির ঘরে ঘরে মণ্ডপে, মণ্ডপে l
”অপরূপা সর্বশক্তি ময়ী জননী
তমো বিনাশিনী
আলোক প্রদায়িনী ”
এই শারদ সুর শুনে সমস্ত দুঃখ, দুর্দশার কথা ভুলে গিয়ে আলোর সন্ধানে ব্রতী হয় আপামর বাঙালি l ঈশ্বর পাটনির সেই চিরন্তন কথাই আজও বাঙালিরা মায়ের কাছে কামনা করে –
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে ‘
বস্তুত, আবহমানকাল ধরে বাংলার শরৎকালের সঙ্গে আগমনী গান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গিয়েছে l
আগমনী গান ছাড়া দেবী দুর্গা অর্থাৎ দেশমাতৃকার আবাহন কোনওমতেই ভাবা যায় না l
কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হল হাল আমলে বাংলার জনপ্রিয় আগমনী গানগুলি চটুল আধুনিক বাংলা গান এবং ফিল্মি হিন্দি গানের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে কালের স্রোতে l
Bio :
তুষার ভট্টাচার্য : নিবন্ধ লেখেন বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্রে ( আজকাল, দৈনিক স্টেটসম্যান , উত্তরের সারাদিন, সুখবর প্রভৃতি পত্রিকায় ) l
কবিতা লেখেন দেশ, কৃত্তিবাস, নবকল্লোল সহ বিভিণ্ন সাহিত্য পত্রিকায় l
দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে সিগনেট প্রেস ( আনন্দ পাবলিশার্স ,কলকাতা ) থেকে l
Tags: The Indian Rover