দুই মিত্র ও গুরুদক্ষিণা - অমৃতা ব্যানার্জী
আর্যাবর্তের দ্বারে সন্ধিক্ষণ সমাগত। প্রারম্ভ হয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, যা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ যুদ্ধ “মহাভারত” আখ্যায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মহান কুরুবংশ আজ দ্বিধা বিভক্ত। পিতামহ, গুরু, ভ্রাতা, সখা – সকল আপনজন পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ অর্জুনের সারথী রূপে তাঁকে দিশা প্রদর্শন করছেন। মহান ভারতভূমিও আজ দ্বিধা বিভক্ত। ভারতভূমির মহান সম্রাটগণ তথা বীরযোদ্ধারা আজ বিভক্ত হয়ে কৌরব ও পাণ্ডব দলে যোগদান করেছে। রণক্ষেত্রের দিকে দিকে কেবল শবের সমাহার, রুধির-ধারা। রমণী ও শিশুদের ক্রন্দনে উদ্বেলিত দিগ্বিদিক। ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করে স্তম্ভিত পবিত্র ভারতভূমি। একটি বংশের ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব সমগ্র আর্যাবর্তকে করছে আলোড়িত, নিশ্চিহ্ন হচ্ছে সর্বস্ব। কিন্তু এই ধ্বংসলীলার জন্য কি কেবল কৌরব ও পাণ্ডবের পারস্পরিক শত্রুতা দায়ী? অথবা বহুপূর্বেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বীজ বপন করা হয়েছিল? সেই রোপণ কার্য ছিল অজ্ঞাত। কেবল কাল প্রত্যক্ষ করেছিল অঙ্কুরোদগম।
পাঞ্চাল রাজ্য থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত ঋষি অগ্নিবেশ্যর আশ্রম। আশ্রমে বসবাসকারী ঋষি অগ্নিবেশ্যর দুই প্রিয় শিষ্য – মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র দ্রোণ এবং পাঞ্চালরাজ পৃষতের পুত্র দ্রুপদ। দ্রুপদ রাজপুত্র। সিংহাসন, সাম্রাজ্য তার ভবিতব্য। কিন্তু দ্রোণের সম্মুখে প্রতীক্ষারত কঠিন ভবিষ্যত। ব্রাহ্মণ-সন্তান হয়েও দ্রোণের মধ্যে ক্ষত্রিয়ের গুণ প্রকট। ব্রাহ্মণের নিত্য কর্ম – পূজা, যজ্ঞ, সাধনা, তাকে আকর্ষণ করে না। অস্ত্রের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ। তাই অস্ত্রশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে দ্রোণ ঋষি অগ্নিবেশ্যর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে। ব্রাহ্মণের ক্ষাত্রগুণ সমাজ সহজে গ্রহণ করে না। অগত্যা দ্রোণের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিও তার প্রতিকূলে। দুই কিশোরের সামাজিক স্তর সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু তারা বন্ধু, বাল্যবন্ধু। বাল্যাবস্থায় মহর্ষি ভরদ্বাজের আশ্রমে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসত দ্রুপদ। সেই সময় হতে উভয়ের বন্ধুত্ব। ঋষি অগ্নিবেশ্যর আশ্রমে সেই বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয়েছে। দ্রোণের ভবিষ্যত কাঠিন্যে পরিপূর্ণ। অস্ত্র প্রেমের জন্য সমাজের সঙ্গে বারংবার দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হবে তাকে। দ্রুপদ দ্রোণের সমস্যা সম্পর্কে অবগত। অগত্যা বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষার জন্য সে দ্রোণকে দেয় এক প্রতিশ্রুতি, ‘দ্রোণ, তুমি আমার পরম মিত্র। আজ হতে যাহা আমার, তাহাই তোমার। ভবিষ্যতে আমার সিংহাসন ও রাজ্যের উপরও তোমার থাকবে সমান অধিকার।’ দ্রুপদের কথন শেষে দুই বন্ধু পরস্পরকে আলিঙ্গন করল। অলক্ষ্যে হাসল নিয়তি।
সময় সদাপ্রবহমান। ঋষি অগ্নিবেশ্যর আশ্রমে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণের পর অতিবাহিত হয়েছে বেশ কিছু বছর। ব্রহ্মচর্য ত্যাগ করে দ্রোণ এবং দ্রুপদ, উভয়ই গৃহস্থ জীবনে প্রবেশ করেছেন। দ্রুপদ এখন পাঞ্চাল সম্রাট। সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসিতা সবই তাঁর করায়ত্ত। বিপরীতে দ্রোণের জীবন কণ্টকাকীর্ণ। কুরুবংশের কুলগুরু কৃপাচার্যের ভগিনী কৃপীর সহিত দ্রোণ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এসেছে তাঁদের একমাত্র সন্তান অশ্বত্থামা। কিন্তু দ্রোণের ছোট্ট নীড় সুখের নয়, তাতে বাস করে চরম বেদনা। যাগযজ্ঞ থেকে দূরে থাকা ব্রাহ্মণকে ব্রাহ্মণ সমাজ সহজে গ্রহণ করে না। দ্রোণ কর্মহীন। তাঁর জীবনের কানায় কানায় পরিপূর্ণ দারিদ্র্য। আপন পুত্র অশ্বত্থামাকে তিনি এক চিলতে দুধ পর্যন্ত দিতে পারেন না। প্রতি মুহূর্তে বিদীর্ণ হয় পিতৃহৃদয়। দ্রোণ বোঝেন, এই রূপে জীবন অতিবাহিত করা অসম্ভব। উপার্জনের পন্থা খোঁজা আবশ্যিক। সহসা দ্রোণের বাল্যবন্ধু দ্রুপদের কথা স্মরণে আসে। সে তো বলেছিল, তার সবকিছুতে দ্রোণের সমান অধিকার। দ্রুপদ আজ সম্রাট। অবশ্যই সে তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি বিস্মৃত নয়। অগত্যা পাঞ্চাল প্রস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন দ্রোণ।
স্ত্রী, পুত্র সহ পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের ভবনে প্রবেশ করেন দ্রোণ। বাল্যবন্ধুকে আলিঙ্গন করার জন্য ধাবিত হন তিনি। কিন্তু দ্রুপদের মধ্যে কোন প্রকার উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হল না। দ্রোণের আগমন দ্রুপদের কাছে কেবল রাজভবনে এক সাধারণ ব্রাহ্মণের আগমন মাত্র। দ্রোণ দ্রুপদকে পূর্ব অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করানোর প্রচেষ্টা করলেন। সবকথা শুনে বিদ্রুপাত্মক স্বরে দ্রুপদ বললেন, ‘হে ব্রাহ্মণ, বাল্যাবস্থার কথা কেইবা স্মরণে রাখে? আপনি ব্রাহ্মণ। সপরিবারে আমার দ্বারে আগত। আপনাকে একটি দিনের জন্য আমার ভবনে বিশ্রাম করার অনুমতি দিতে পারি। এর অধিক কিছু নয়। রাজসিংহাসনে আপনার কোন অধিকার নেই।’
চরম অপমানিত বোধ করলেন দ্রোণ। তাঁর পরম মিত্র আজ এইরূপে তাঁকে অপমানিত করল! ভিক্ষুকের ন্যায় এক মুহূর্তের জন্যও তিনি পাঞ্চালরাজের ভবনে থেকে আশ্রয় ভিক্ষা করবেন না। পরিবারের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ রাজভবন ত্যাগ করলেন দ্রোণ। কিন্তু তাঁর হৃদয়ে প্রজ্বলিত হল অপমানের অগ্নি। অপমানের প্রতিকার না করা পর্যন্ত সেই অগ্নি নির্বাপিত হবে না।
দ্রোণ বর্তমানে আশ্রয়হীন। প্রয়োজন আশ্রয় এবং উপার্জনের পন্থা। উপার্জন করে দ্রুপদকে যোগ্য উত্তর দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন দ্রোণ। আশ্রয়ের কথা ভাবামাত্র দ্রোণের স্মরণে এলেন কৃপাচার্য। তাঁর শ্যালক কৃপাচার্য কুরুবংশের কুলগুরু। হস্তিনাপুরে নিজ গৃহে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত করেন তিনি। অগত্যা হস্তিনাপুর গমনের সিদ্ধান্ত নেন দ্রোণ।
কিছুকাল যাবৎ সপরিবারে কৃপাচার্যের গৃহে বসবাস করছেন দ্রোণ। কিন্তু উপার্জনের পন্থা এখনও তিনি নির্ধারণ করতে পারেননি। এমতাবস্থায় একটি সংবাদ তাঁর কর্ণগোচর হল। মহামতি ভীষ্ম কুরু রাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষার বিষয়ে চিন্তিত।
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্র। স্বর্গীয় মহারাজ পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র। সকল রাজকুমার কিশোর। কিন্তু এখনও তাদের উপযুক্ত অস্ত্রশিক্ষা প্রারম্ভ হয়নি। কৃপাচার্য ও বিদুরের কাছে তারা অস্ত্রশিক্ষা লাভ করে ঠিকই, কিন্তু মহামতি ভীষ্ম সন্তুষ্ট নন। তাঁর ইচ্ছা, কুরু রাজকুমারেরা হোক জগতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা নির্মাণের জন্য প্রয়োজন শ্রেষ্ঠ গুরু। মহামতি ভাবেন, কোথায় সেই শ্রেষ্ঠ গুরু?
মহামতি ভীষ্মের ইচ্ছের কথা জ্ঞাত হওয়া মাত্র জীবনের নতুন দিশা সন্ধান পেলেন দ্রোণ। অস্ত্রবিদ্যায় তিনি শ্রেষ্ঠ। মহর্ষি ভরদ্বাজের আগ্নেয়াস্ত্রের অধিকারীও তিনি। অগত্যা তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ অস্ত্রগুরু কেইবা হতে পারে?
অন্তরালে থেকে কুরু রাজকুমারদের পর্যবেক্ষণ করলেন দ্রোণ। রাজকুমাররেরা বুদ্ধিমান অবশ্যই, কিন্তু সঠিক পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন। নল-খাগড়ার দ্বারা নির্মিত শরের সাহায্যে গভীর কুয়ো থেকে ক্ষুদ্র ক্রীড়নক উদ্ধার করে রাজকুমারদের চমৎকৃত করলেন দ্রোণ।
রাজকুমারগণের থেকে আশ্চর্য ব্রাহ্মণ সম্পর্কে অবহিত হলেন মহামতি ভীষ্ম। বুঝলেন, সেই ব্রাহ্মণ মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র দ্রোণ ব্যতীত অন্য কেউ হওয়া অসম্ভব। মহামতি ভীষ্ম দ্রোণের ক্ষাত্রগুণ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত। অগত্যা মহামতির নিবেদনে দ্রোণ কুরু রাজকুমারদের অস্ত্রগুরু রূপে নিযুক্ত হলেন।
হস্তিনাপুরের শেষ প্রান্তে নির্মিত হল আশ্রম। সেই আশ্রমে প্রারম্ভ হল রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা। দ্রোণের নব পরিচয় দ্রোণাচার্য।
অতিবাহিত হল বেশ কিছু বছর। কুরু রাজকুমারগণের অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে। দ্রোণাচার্যের শিক্ষা লাভ করে তারা এখন মহাপরাক্রমী যোদ্ধা। কিন্তু বাস্তবিক রণক্ষেত্রের জ্ঞান তাদের নেই। রণক্ষেত্রের জন্য তারা ঠিক কতটা প্রস্তুত, তা পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়।
দ্রোণাচার্য বুঝলেন, উপযুক্ত সময় সমাগত। এইবার শিষ্যরা তাঁর হৃদয়ে প্রজ্বলিত অপমানের বহ্নিশিখা নির্বাপিত করবে। এই সুযোগে তাদের অন্তিম পরীক্ষাও নেওয়া যাবে।
মহামতি ভীষ্ম এবং মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সম্মুখে দ্রোণাচার্য ব্যক্ত করলেন তাঁর কথা। শিষ্যদের কাছে গুরুদক্ষিণা চাই তাঁর। গুরুদক্ষিণা স্বরূপ, কুরু রাজকুমাগণ পাঞ্চাল রাজ্য আক্রমণ করে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে পরাভূত করবে। গুরুদক্ষিণা ব্যতীত শিক্ষা অসম্পূর্ণ। অগত্যা কুরুবংশ দ্রোণাচার্যকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত গুরুদক্ষিণা দিতে স্বীকৃত হল।
কুরু রাজকুমারগণ পাঞ্চাল রাজ্য আক্রমণ করলেন। কাম্পিল্য নগরীর থেকে সামান্য দূরে যুদ্ধ প্রারম্ভ হল।
পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ অর্জুনের নিকট নতিস্বীকার করতে বাধ্য হলেন মহারাজ দ্রুপদ। দ্রুপদকে হত্যা করলেন না অর্জুন। হস্তিনাপুরের সঙ্গে পাঞ্চালের পূর্ব আত্মীয়তার জন্য অর্জুন দ্রুপদকে অসম্মান করলেন না। কেবল গুরুদক্ষিণার দায়বদ্ধতার জন্য তাঁকে দ্রোণাচার্যের পদতলে নিয়ে এলেন।
শান্ত হল দ্রোণাচার্যের হৃদয়ে প্রজ্বলিত অগ্নি। পাঞ্চাল রাজ্য অধিকার করলেন তিনি। কিন্তু বাল্যবন্ধুকে সম্পূর্ণ রূপে রাজ্যচ্যুত করলেন না তিনি। দ্বিখণ্ডিত হল পাঞ্চাল রাজ্য। গঙ্গার উত্তর দিক অধিগ্রহণ করলেন দ্রোণাচার্য এবং দক্ষিণ দিকের অধিকার রইল দ্রুপদের।
রণক্ষেত্র শান্ত। কিন্তু অপমানের অগ্নি প্রজ্বলিত হল দ্রুপদের হৃদয়ে। তিনি দ্রোণাচার্যকে অপমানের প্রত্যুত্তর দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন। দ্রুপদ কামনা করলেন এক পুত্র, যে দ্রোণের শিরশ্ছেদ করবে। কাঙ্ক্ষিত পুত্র লাভের জন্য প্রারম্ভ হল এক মহাযজ্ঞ। সেই যজ্ঞের অগ্নি হতে এক পুত্রর সহিত জন্ম নিল এক কন্যা। আর্যাবর্তের আমূল পরিবর্তনের জন্য ধরণীতে এলেন দ্রৌপদী।
দুই মিত্রর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও এক গুরুদক্ষিণা বদলে দিল আর্যাবর্তের কাহিনী। প্রারম্ভ হল “মহাভারত”।
লেখক পরিচিতি:
অমৃতা ব্যানার্জী পেশায় একজন তথ্য প্রযুক্তি ইঞ্জিনিয়ার। সাহিত্য জগত, বিশেষতঃ বাংলা সাহিত্যের প্রতি অমৃতার প্রবল আকর্ষণ। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও গল্প সংকলনে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতের জন্য নির্বাচিত হয়েছে।