“যোগ ” – শান্তিক্ষেত্র - শ্রীরূপ বিট

বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম ভরসা যেমন মাস্ক, তেমনি মানসিক বা শারীরিক যাই হোক না কেন! রোগময় পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম অবলম্বন হল “যোগ”। বলতে গেলে যোগ হলো শরীর ও মনের এক প্রকার মাস্ক। আমরা প্রায় সকল ভারতবাসী তথা বিশ্ববাসী “যোগ” শব্দের সাথে এখন ভালোই পরিচিত বললেই চলে। তবে “যোগ” বলতে প্রথমেই যোগাসন এবং প্রাণায়াম অভ্যাসকে সচরাচর ধরা হয়, কারণ যোগের অর্থ হলো শরীর ও মন ভালো ও সুস্থ রাখা।
গাণিতিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখতে গেলে “যোগ” অর্থে আমরা “+” এই চিহ্নকে বুঝে থাকি। রক্তের শ্রেণীতে এই চিহ্নটিকে বলা হয় “পজিটিভ” অর্থাৎ “ইতিবাচক”। সকলের রক্তের শ্রেণী আলাদা হতে পারে, যেমন – “এ- পজিটিভ”, “ও- পজিটিভ”, “ও- নেগেটিভ” ইত্যাদি ; কিন্তু মনের শ্রেণী অনুযায়ী সকলের গ্রুপ একটাই হওয়া উচিত; আর সেটা হলো – “বি- পজিটিভ” (Be positive)। যা করতে যোগ আমাদের শেখায়।
জন্ম থেকে পথ চলা শুরু হবার সাথে সাথে যে দড়ির সঙ্গে আমরা পুরোপুরি বাঁধা পড়ে যায়, সেই দড়িটা হলো – “সম্পর্ক”। আর সেই প্রত্যেক সম্পর্কের দড়িতে যে যে নিজেদের সাথে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে, তাদের সাথে সেই দড়ির বন্ধনকে অক্ষত রাখার কর্তব্য মৃত্যু পর্যন্ত পালন করে যেতেই হয়। বাস্তব সমাজে এই সম্পর্ক রক্ষার্থে কেউ হীনমন্যতা, কেউ নৈরাশ্যতা এবং কেউ হত্যা পর্যন্ত করতে বাধ্য হয়। যদি গীতার আঠারোটি অধ্যায় পর্যবেক্ষণ করা হয়, তবে প্রতি অধ্যায়ে সকল উপদেশের মাঝে শ্রীকৃষ্ণ একটাই বার্তা অর্জুনকে প্রদান করছেন। আর সেই বার্তাটি হলো : “হে অর্জুন! তুমি যোগযুক্ত হও।” যদি সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই বার্তা প্রয়োগ করা হয়, তবে কেমন হয়?
আমাদের হিন্দু শাস্ত্রে অন্যতম বিশেষ তিন ধরনের যোগের পন্থা উল্লেখ রয়েছে। যথা – জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ এবং কর্মযোগ। একটু স্থিরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, এই তিনটি যোগ পন্থার ভিত মনের প্রধান তিন শক্তি, যথা- জ্ঞানযোগের ভিত চিন্তাশক্তি, ভক্তিযোগের অনুভূতিশক্তি এবং কর্মযোগের ইচ্ছাশক্তি। সমগ্র বিশ্বে প্রত্যেকেই এই তিন শক্তির ভিত্তিতে জীবন পথে এগিয়ে চলে। এই তিন বিনা সবকিছুই অচল। এককথায় বলা চলে, রক্ত মাংসের দেহের ভিতরে এই তিন শক্তি দিয়ে গঠিত রয়েছে আরেকটি দেহ, যা হলো আমাদের সূক্ষ্ম দেহ। আসলে এই তিনশক্তি যখন ব্রহ্মজ্যোতির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় তখন তা হয়ে যায় যোগ, যার বিবরণ হিন্দু দর্শন দেয়। তাহলে সামাজিক জীবনে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায় কীভাবে?
বর্তমানে অধিকাংশ সম্পর্ক ছিন্ন হবার মূল কারণ যে বোঝাপড়া বা সমন্বয় সাধনের অভাব, তার উদাহরণ হিসেবে বলা যায় – একটি দীর্ঘ ব্যস্ততম রাস্তার একপ্রান্তে থাকা একটি মানুষ ঠিক তার অপর প্রান্তে থাকা আরেকটি মানুষকে চিৎকার করে ডাকা সত্ত্বেও সে শুনতে পেলো না, আবার সেই মানুষটি যখন পূর্বের মানুষটিকে দেখতে পেয়ে ডাকলো তখন পূর্বের মানুষটিও শুনতে অক্ষম হলো। ফলে দুজনের মনে একপ্রকার ধারণা সৃষ্টি হলো যে, এতো করে ডাকা সত্ত্বেও যেহেতু ও ইচ্ছে করে সাড়া দিল না, সেহেতু আজ থেকে আর কোনোদিনও ওকে ডাকবো না। ব্যাস! উভয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে গেল এক বিচ্ছিন্নতার প্রাচীর। যদি ওই রাস্তাটি সম্পর্ক হয়, তাহলে ঐ মানুষ দুটি হলো সম্পর্কের দুই মেরু অর্থাৎ যে দুজনকে নিয়ে সম্পর্ক। আর বেশিরভাগ সম্পর্ক এভাবেই ভুলবোঝা পড়াতেই ছিন্ন হয়।
এবার আসি, উপরিক্ত তিন শক্তি অর্থাৎ চিন্তা, অনুভূতি এবং ইচ্ছা – এদের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে কিভাবে সমন্বয় সাধন করা সম্ভব তা ব্যাখ্যা করলে বলতে হয় – উপরিক্ত উদাহরণে শুরুতেই বলা হয়েছে যে, রাস্তাটি ছিল দীর্ঘ এবং ব্যস্ততম। অর্থাৎ, উভয় প্রান্তের মধ্যে একটি ব্যক্তিও অপর ব্যক্তির সাড়া না পাবার পর যদি প্রথমে চিন্তাশক্তিকে প্রয়োগ করতো, তবে সে তার না শোনার পিছনে নিশ্চয় কারণগুলি অনুসন্ধান করতো, সেটা রাস্তার দীর্ঘতা হোক বা যানবাহনের শব্দ। এরপরে সে তার অনুভূতি শক্তি যদি প্রয়োগ করতো, তবে অনুভব করতো যে, যদি তাকেও অপরদিক থেকে এই পরিস্থিতিতে ডাকা হয় তবে না শোনাটাই স্বাভাবিক। পরিশেষে সে ইচ্ছাশক্তি যদি প্রয়োগ করতো, তাহলে পরবর্তীকালে সে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার পরিবর্তে যুক্ত থাকার আগ্রহ প্রকাশ করতো।
সুতরাং , সম্পর্কের বিরোধক্ষণে চিন্তা বিরোধের মূল কারণ ধরতে, অনুভূতি অপরকে কঠোর আচরণে আঘাত দেওয়ার পূর্বে নিজেকে দিয়ে বিচার করতে এবং ইচ্ছা পুনরায় আগের মতো অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রধান সহায় হয়ে ওঠে। আর এই তিনের প্রয়োগ হলে সেই ব্যক্তি অজান্তে তার নিম্নমানের অহংকে (Ego) ত্যাগ করে নিজের এবং অপরের মানসিক শান্তি আনতে সক্ষম হয়। কারণ বিচ্ছিন্নতা বা “বিয়োগ” আর যাই হোক কখনও শান্তি লাভে সক্ষম হয় না। তাই বাস্তব জীবনে সকলের সাথে যোগ রেখে চলাই যেহেতু ধর্ম তাই সঠিক সময়ে এই তিনের প্রয়োগ করাও একপ্রকার যোগ বটে। কারণ “যোগ” শুধু শারীরিক নয়, মানসিক শান্তিরও এক মোক্ষম উপায় অর্থাৎ যোগই স্বয়ং ‘শান্তিক্ষেত্র’। তাই সমাপ্তি জুড়ে থাক বেদান্তের সেই শান্তির বাণী:
ওঁ সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ।
সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু মা কশ্চিৎ দুঃখভাগ্ভবেৎ।।
ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি।।